দশম হিজরিতে রাসুল সাল্লাহু আলাইহি ওসাল্লাম জীবনের শেষ হজ করেন। জিলহজ
মাসের ৯ তারিখ দুপুরের পর জাবালে রহমতে দাঁড়িয়ে বৃহত্তম গণসমাবেশে জীবনের
শেষ দিকনির্দেশনা দেন।
(এই ভাষণের পূর্ণরূপ সংরক্ষিত নেই। বুখারি
শরিফে কিছু অংশ পাওয়া যায়, যা নির্ভরযোগ্য সূত্র বিবেচনায় উদ্ধৃত হয়ে
থাকে। সংশ্লিষ্ট হাদিসগুলো হলো_হাদিস নম্বর ১৬২৩, ১৬২৬ ও ৬৩৬১।)
১৩টি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে ভাষণের সংশ্লিষ্ট অনুবাদ নিম্নরূপ :
#
(জীবনাবসনের ইঙ্গিত দিয়ে বলেন)হে লোকেরা! আমার কথাগুলো মনোযোগসহ শ্রবণ
করো। আমার মনে হয়, এরপর আর আমার পক্ষে হজের মহান আনুষ্ঠানিকতায় যোগদান
করা সম্ভব হবে না।’
# (হত্যার বদলে হত্যা প্রথা বন্ধ করে বলেন
)‘শুনে রাখো, অন্ধকার যুগের সব কুসংস্কার, অন্ধবিশ্বাস আর অনাচার আজ আমার
পায়ের নিচে দাফন করা হলো। বর্বর যুগের শোণিত-প্রতিশোধ প্রথা আজ থেকে রহিত
করা হলো।… আমি সর্বপ্রথম আমার স্বগোত্রের প্রাপ্য সুদ এবং সব ধরনের রক্তের
দাবি রহিত ঘোষণা করছি।… মনে রেখো! একজনের অপরাধে অন্যকে দণ্ড দেওয়া যাবে
না। পিতার অপরাধে পুত্র এবং পুত্রের অপরাধে পিতাকে অভিযুক্ত করা চলবে না।’
#
(সুদ প্রথা সম্পর্কে বলেন )অজ্ঞ যুগের সব সুদ আজ থেকে বাতিল করা হলো। আমি
সর্বপ্রথম আমার স্বগোত্রের প্রাপ্য সুদ ও সব ধরনের রক্তের দাবি রহিত ঘোষণা
করছি।’
# (নেতৃত্বের প্রতি আনুগত্যের ব্যাপারে বলেন)যদি কোনো
নাককাটা হাবশি ক্রীতদাসকেও তোমাদের আমির নিযুক্ত করা হয় এবং সে আল্লাহর
কিতাব অনুসারে তোমাদের পরিচালনা করে, তাহলে তোমরা সর্বতোভাবে তার আনুগত্য
করবে, তার আদেশ মান্য করবে। সাবধান!’
# (ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়ি
সম্পর্কে বলেন)ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়ি করবে না। এতদ্বিষয়ে সীমালঙ্ঘনের
কারণে তোমাদের পূর্ববর্তী বহু জাতি ধ্বংস হয়ে গেছে। মনে রেখো! তোমাদের
সবাইকেই আল্লাহর দরবারে উপস্থিত হতে হবে। তাঁর কাছে এসব কথার জবাবদিহি করতে
হবে। সাবধান, তোমরা খোদাদ্রোহী হয়ে পরস্পর রক্তপাতে লিপ্ত হয়ো না।’
#
(অন্যের সম্পত্তি, ইজ্জতের হেফাজত সম্পর্কে বলেন)স্মরণ রেখো, আজকের এই
দিন, এই মাস যেমন মহিমান্বিত, মক্কার হেরেম যেমন পবিত্র, প্রতিটি মুসলমানের
ধনসম্পদ, সবার ইজ্জত-সম্ভ্রম এবং প্রতিটি মুসলমানের রক্তবিন্দু তোমাদের
কাছে সে রকমই পবিত্র। আগের বিষয়গুলোর পবিত্রতা নষ্ট করা যেমন তোমরা
পরিত্যাজ্য ও হারাম বলে জানো, তেমনি কোনো মুসলমানের সম্পদ, সম্ভ্রম ও
জীবনের ক্ষতিসাধন তোমাদের জন্য নিষিদ্ধ, মহাপাপ।’
#
(মানুষে-মানুষে ভেদাভেদ নেই সে ব্যাপারে বলেন)‘অনারবদের ওপর আরবদের
প্রাধান্যের কোনো কারণ নেই। শ্বেতাঙ্গ-কৃষ্ণাঙ্গেও ভেদাভেদ নেই।
প্রাধান্যের মাপকাঠি হলো একমাত্র খোদাভীতি। মানুষ সবাই আদমের সন্তান আর আদম
মাটি থেকে সৃষ্ট। জেনে রাখো, জগতের সব মুসলমান মিলে এক অবিচ্ছেদ্য
ভ্রাতৃসংঘ।’
# (শেষ নবী এর ব্যাপারে বলেন) হে লোকেরা, জেনে রাখো,
আমার পরে আর কোনো নবীর আগমন হবে না। আমি যা বলছি, মনোযোগ দিয়ে শোনো। এ
বছরের পর হয়তো তোমরা আর আমার সাক্ষাৎ পাবে না। জ্ঞান উঠে যাওয়ার আগেই
আমার কাছ থেকে শিখে নাও। চারটি বিষয় বিশেষ করে স্মরণ রেখো! (১) কখনো শিরক
করো না, (২) অন্যায়ভাবে নরহত্যা করো না, (৩) অন্যের সম্পদ আত্মসাৎ করো না,
(৪) কখনো ব্যভিচারে লিপ্ত হয়ো না। সাবধান, কারো অসম্মতিতে তার সামান্য
সম্পদও গ্রহণ করো না। জুলুম করো না। জুলুম করো না! কোনো মানুষের ওপর জুলুম
করো না।’
# (শয়তান সম্পর্কে সাবধানবাণী দিয়ে বলেন)আমি তোমাদের
কাছে যা রেখে যাচ্ছি, যত দিন তোমরা সেগুলো আঁকড়ে ধরে রাখবে, পথভ্রষ্ট হবে
না। আর তা হলো আল্লাহর কিতাব এবং তাঁর রাসুলের সুন্নাত। হে লোকেরা, সাবধান!
এমন অনেক বিষয়কে তোমরা ক্ষুদ্র বলে জ্ঞান করো, অথচ শয়তান তারই মাধ্যমে
তোমাদের সর্বনাশ করে ছাড়ে। সে বিষয়গুলো সম্পর্কে খুবই সাবধান থাকবে।’
#
(স্ত্রীদের প্রতি সদাচরণ সম্পর্কে বলেন)অতঃপর, হে লোকেরা! নারীদের বিষয়ে
আমি তোমাদের সতর্ক করছি। তাদের প্রতি নির্দয় ব্যবহার করার সময় তোমরা
আল্লাহর শাস্তির কথা ভুলে যেয়ো না। নিশ্চয়ই তোমরা তাদের আল্লাহর জামিনে
গ্রহণ করেছ এবং তাঁরই কালাম দ্বারা তাদের সঙ্গে তোমাদের দাম্পত্য সম্পর্ক
স্থাপিত হয়েছে। মনে রেখো, তোমাদের সহধর্মিণীদের ওপর তোমাদের যেমন
দাবিদাওয়া ও অধিকার রয়েছে, তেমনি তোমাদের ওপরও তাদের দাবিদাওয়া ও
স্বত্বাধিকার রয়েছে। পরস্পরকে নারীদের সঙ্গে সদ্ব্যবহারে উদ্বুদ্ধ করবে।
স্মরণ রাখবে, এ অসহায়দের একমাত্র সহায় তোমরাই।’
# (দাস-দাসীদের
প্রতি সদ্ব্যবহার সম্পর্কে বলেন) স্মরণ রেখো, তোমাদের অধীন দাস-দাসীরা
অসহায়-নিরাশ্রয়। সাবধান! তাদের ওপর কখনো জুলুম করবে না, তাদের অন্তরে
আঘাত দেবে না। তোমাদের মতো তাদেরও একটি হৃদয় আছে। ব্যথা দিলে কষ্ট পায় আর
আনন্দে আপ্লুত হয়। শুনে রাখো! ইসলামের নির্দেশ হলো, তোমরা যা খাবে
দাস-দাসীদেরও তা-ই খাওয়াবে। তোমরা যা পরবে, তাদের তা-ই পরাবে। কোনো ধরনের
তারতম্য করা চলবে না।’
# (আত্মপরিচয় অস্বীকারের বিষয়ে নিষেধ করে
বলেন) যে নিজের বংশের পরিবর্তে নিজেকে অন্য বংশের বলে প্রচার করে, তার ওপর
আল্লাহর, ফেরেশতাকুলের ও সমগ্র মানবজাতির অনন্ত অভিশাপ।’
#
(কোরআনের বাণী প্রচা্রের ব্যাপারে বলেন )আমি তোমাদের কাছে আল্লাহর কিতাব
রেখে যাচ্ছি। যত দিন তোমরা সে কিতাব অবলম্বন করে চলবে, তোমরা পথভ্রষ্ট হবে
না। আজ যারা এখানে উপস্থিত আছ, তারা আমার এসব পয়গাম অনুপস্থিতদের কাছে
পোঁছে দেবে। হতে পারে উপস্থিত কারো কারো থেকে অনুপস্থিত কেউ কেউ এর দ্বারা
বেশি উপকৃত হবে।’
হজরত মুহাম্মদ সাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দেড়
লাখ সহচরের বিশাল হজ সমাবেশের মধ্যে তাঁর ভাষণের একেকটি বাক্য উচ্চারণ
করছিলেন আর সম্মেলনস্থলের বিভিন্ন কেন্দ্রে দাঁড়িয়ে থাকা তাঁর নকিবরা
সম্মিলিত কণ্ঠে তাঁর প্রতিধ্বনি করে বিশাল সমাবেশের সব প্রান্তে মুহাম্মদ
সাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর বাণী পৌঁছে দিচ্ছিলেন। অতঃপর, রাসুল
মুহাম্মদ সাল্লাহু আলাইহি ওসাল্লাম আকাশের দিকে মুখ তুলে বললেন, ‘হে
আল্লাহ, আমি কি তোমার বাণী পৌঁছে দিয়েছি_আমি কি আমার দায়িত্ব পালন
করেছি?’উপস্থিত জনতার কণ্ঠে উচ্চারিত হয়_নিশ্চয়ই। নিশ্চয়ই। তখন মুহাম্মদ
সাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছিলেন, ‘হে আল্লাহ, তুমি শোনো, সাক্ষী
থাকো, তোমার দাসরা স্বীকার করছে, আমি আমার দায়িত্ব পালন করেছি। হে আল্লাহ,
তুমি সাক্ষী থাকো।’
.....................................................................................
এই মুহূর্তে কুরআনের শেষ আয়াতটি নাজিল হয়।
‘আজকের এই দিনে তোমাদের দীনকে পূর্ণ করে দিলাম। তোমাদের ওপর আমার
নিয়ামত পূর্ণকরে দিলাম। ইসলামকেই তোমাদের ওপর দীন হিসেবে মনোনীত করলাম।’(
সুরা আল মায়েদাহ – ৩)
....................................................................................
{প্রতিটি
মুসলিমের দায়িত্ব বিদায় হজ্বের ভাষণকে নিজের জীবনে এপ্লাই করা, দয়া করে
ভাষণের একটি কপি আপনার ঘরে রাখুন এবং ইমেইল/শেয়ার করে আপনার বন্ধুকে পড়তে
সহায়তা করুন।
আজকাল মুসলিমদের অন্তরে এক রুপ এবং বাহিরে
আরেক রুপ। তাই আমরা আজ অপদস্ত হচ্ছি সময়ে অসময়ে। চলুন আগে নিজের অন্তরকে
ঠিক করি, আল্লাহকে ভয় করি এবং রাসুলের সুন্নত অনুসারে চলি। তাহলেই আমাদের
ঈমান শক্ত হবে এবং আমাদের পারিবারিক ও সামাজিক জীবনে শান্তি নেমে আসবে।}
No comments:
Post a Comment