Saturday, May 14, 2016

'লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ' মেনে চলার শর্তাবলী

*লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ (কালেমা তাইয়েবা) মেনে চলার শর্তাবলী*

Image result for ramadan

এক : কালেমা তাইয়েবার অর্থ জানা।
অর্থাৎ এ কালেমার দুটো অংশ রয়েছে তা পরিপূর্ণভাবে জানা।
সে দুটো অংশ হলো:
১.    কোন হক মা’বুদ নেই
২.    আল্লাহ ছাড়া (অর্থাৎ তিনিই শুধু মা’বুদ)

দুই : কালেমা তাইয়েবার উপর বিশ্বাস স্থাপন করা।
অর্থাৎ সর্ব-প্রকার সন্দেহ ও সংশয়মুক্ত পরিপূর্ণ বিশ্বাস থাকা।

তিন : কালেমার উপর এমন একাগ্রতা ও নিষ্ঠা রাখা, যা সর্বপ্রকার শিরকের পরিপন্থী।

চার : কালেমাকে মনে প্রাণে সত্য বলে জানা, যাতে কোন প্রকার মিথ্যা বা কপটতা না থাকে।

পাঁচ : এ কালেমার প্রতি ভালবাসা পোষণ এবং কালেমার অর্থকে মনে প্রাণে মেনে নেয়া ও তাতে খুশী হওয়া।

ছয় : এই কালেমার অর্পিত দায়িত্ব সমূহ মেনে নেয়া অর্থাৎ এই কালেমা কর্তৃক আরোপিত ওয়াজিব কাজসমূহ শুধুমাত্র আল্লাহর জন্য এবং তাঁরই সন্তুষ্টির নিমিত্তে সমাধা করা।

সাত : মনে-প্রাণে এই কালেমাকে গ্রহণ করা যাতে কখনো বিরোধিতা করা না হয়।

কালেমা তাইয়েবার যে সমস্ত শর্ত বর্ণিত হলো, তার সমর্থনে কোরআন ও হাদিস থেকে দলিল প্রমাণাদি:

প্রথম শর্ত: 
কালেমার অর্থ জানা। এর দলিল :

আল্লাহর বাণী:
“জেনে রাখুন নিশ্চয়ই আল্লাহ ছাড়া কোন হক মা‘বুদ নেই।”[সূরা মুহাম্মাদ: ১৯]।
আল্লাহ আরও বলেন:
“তবে যারা হক (লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু) এর সাক্ষ্য দিবে এমনভাবে যে, তারা তা জেনে শুনেই দিচ্ছে অর্থাৎ তারা জাহান্নাম থেকে মুক্তি পাবে।” [সূরা আয-যুখরুফ: ৮৬]

এখানে জেনে শুনে সাক্ষ্য দেয়ার অর্থ হলো তারা মুখে যা উচ্চারণ করছে তাদের অন্তর তা সম্যকভাবে জানে।
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন : “যে ব্যক্তি এমতাবস্থায় মারা যায় যে সে জানে আল্লাহ ছাড়া কোন সঠিক উপাস্য নেই সে জান্নাতে যাবে।”[1]

দ্বিতীয় শর্ত : 
কালেমার উপর বিশ্বাসী হওয়া। এর প্রমাণাদি:
আল্লাহ তা‘আলা বলেন : “নিশ্চয়ই মুমিন ওরাই যারা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের উপর ঈমান এনেছে, অতঃপর এতে কোন সন্দেহ-সংশয়ে পড়ে নি এবং তাদের জান ও মাল দিয়ে আল্লাহর রাস্তায় জিহাদ করেছে। তারাই তো সত্যবাদী।” [সুরা আল-হুজুরাত: ১৫]
এ আয়াতে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের উপর ঈমান যথাযথভাবে হওয়ার জন্য সন্দেহ-সংশয়মুক্ত হওয়ার শর্ত আরোপ করা হয়েছে, অর্থাৎ তারা সন্দেহ করে নি। কিন্তু যে সন্দেহ করবে সে মুনাফিক, ভণ্ড (কপট বিশ্বাসী)।
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন: “আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, আল্লাহ ছাড়া কোন সঠিক মা’বুদ বা উপাস্য নেই, আর আমি আল্লাহর রাসূল। যে বান্দা এ দুটো বিষয়ে সন্দেহ-সংশয়মুক্ত অবস্থায় আল্লাহর সাক্ষাতে হাজির হবে, সে জান্নাতে প্রবেশ করবে।”[2]
আর এক বর্ণনায় এসেছে : “কোন ব্যক্তি এ দুটি নিয়ে সন্দেহহীন অবস্থায় আল্লাহর সাক্ষাতে হাজির হবে জান্নাতে যাওয়ার পথে তার কোন বাধা থাকবে না।”[3]
আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু হতে অপর এক হাদিসের বর্ণনায় রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাকে বলেছিলেন: “তুমি এ বাগানের পিছনে এমন যাকেই পাও, যে মনের পরিপূর্ণ বিশ্বাস এর সাথে এ-সাক্ষ্য দিবে যে, আল্লাহ ছাড়া কোন সঠিক মা’বুদ নেই— তাকেই জান্নাতের সুসংবাদ প্রদান করবে।”[4]
তৃতীয় শর্ত : 
 এ কালেমাকে ইখলাস বা নিষ্ঠা সহকারে স্বীকার করা। এর দলীল:
আল্লাহ তা‘আলা বলেন: “তবে জেনে রাখ দীন খালেস সহকারে বা নিষ্ঠা সহকারে কেবলমাত্র আল্লাহর জন্যই।” [সূরা আয্‌-যুমার: ৩]
আল্লাহ আরও বলেন: “তাদেরকে এ নির্দেশই শুধু প্রদান করা হয়েছে যে, তারা নিজেদের দীনকে আল্লাহর জন্যই খালেস করে সম্পূর্ণরূপে একনিষ্ঠ ও একমুখী হয়ে তাঁরই ইবাদাত করবে।”[সূরা আল-বাইয়েনাহ: ৫]
হাদিস শরিফে আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত আছে, তিনি বলেন: রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন:“আমার সুপারিশ দ্বারা ঐ ব্যক্তিই বেশি সৌভাগ্যবান হবে যে অন্তর থেকে একনিষ্ঠভাবে বলেছে, আল্লাহ ছাড়া কোনো সত্যিকার উপাস্য নেই।”[5]
অপর এক সহিহ হাদিসে সাহাবি উত্‌বান ইব্‌ন মালিক রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত আছে, তিনি বলেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন : “যে ব্যক্তি কেবলমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে لا إله إلا الله বা আল্লাহ ছাড়া হক কোন মা’বুদ নেই বলেছে, আল্লাহ তার জন্য জাহান্নাম হারাম করেছেন।”[6]
ইমাম নাসায়ি রহমাতুল্লাহি আলাইহি তাঁর বিখ্যাত “দিন-রাত্রির যিক্‌র” নামক গ্রন্থে বর্ণনা করেছেন: রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন: “যে ব্যক্তি মনের নিষ্ঠা সহকারে এবং মুখে সত্য জেনে নিম্নোক্ত কলেমাসমূাহ বলবে আল্লাহ সেগুলোর জন্য আকাশকে বিদীর্ণ করবেন যাতে তার দ্বারা জমিনের মাঝে কে এই কালেমাগুলি বলেছে তার প্রতি দৃষ্টি নিক্ষেপ করেন। আর যার দিকে আল্লাহর নজর পড়বে তার প্রার্থিত ও কাঙ্ক্ষিত বস্তু তাকে দেয়া আল্লাহর দায়িত্ব। সে কালেমাগুলি হলো:
لا إله إلا الله وحده لا شريك له، له الملك وله الحمد وهو على كل شيء قدير
অর্থাৎ : “শুধুমাত্র আল্লাহ ছাড়া হক কোন মা’বুদ নেই, তার কোন শরিক বা অংশীদার নেই, তার জন্যই সমস্ত রাজত্ব বা একচ্ছত্র মালিকানা, তার জন্যই সমস্ত প্রশংসা আর তিনি প্রত্যেক বস্তুর উপর ক্ষমতাবান”।[7] 

চতুর্থ শর্ত : 
কলেমাকে মনে প্রাণে সত্য বলে জানা। এর দলীল:
আল্লাহ তা‘আলা বলেন: “আলিফ-লাম-মীম, মানুষ কি ধারণা করেছে যে, ঈমান এনেছি বললেই তাদেরকে ছেড়ে দেয়া হবে আর তাদের পরীক্ষা করা হবে না? আমি তাদের পূর্ববর্তীদের পরীক্ষা করেছি যাতে আল্লাহর সাথে যারা সত্য বলেছে তাদেরকে স্পষ্ট করে দেন এবং যারা মিথ্যা বলেছে তাদেরকেও স্পষ্ট করে দেন।” [সূরা আল-আনকাবুত: ১-৩]
আল্লাহ তা‘আলা আরও বলেন : “মানুষের মাঝে কেউ কেউ বলে আমরা আল্লাহ এবং পরকালের উপর ঈমান এনেছি, অথচ তারা ইমানদার নয়। তারা (তাদের ধারণামতে) আল্লাহ ও ইমানদারদের সাথে প্রতারণা করছে, অথচ (তারা জানে না) তারা কেবল তাদের আত্মাকেই প্রতারিত করছে কিন্তু তারা তা বুঝতেই পারছে না। তাদের অন্তরে রয়েছে ব্যাধি, ফলে আল্লাহ সে ব্যাধিকে আরও বাড়িয়ে দিয়েছেন, আর মিথ্যা বলার কারণে তাদের জন্য রয়েছে কষ্টদায়ক শাস্তি।” [সূরা আল-বাকারা: ৮-১০]
তেমনিভাবে হাদিস শরিফে মু‘আয ইব্‌ন জাবাল রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন: রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন: “যেকোনো লোক মন থেকে সত্য জেনে এ-সাক্ষ্য দিবে যে, আল্লাহ ব্যতীত হক কোন মা’বুদ নেই আর মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর বান্দা ও রাসূল, আল্লাহ তার জন্য জাহান্নাম হারাম করেছেন।”[8] 

পঞ্চম শর্ত : 
এ কালেমাকে মনে প্রাণে ভালবাসা। এর দলীল:
আল্লাহ তা‘আলা বলেন : “কোনো কোনো লোক আল্লাহ ছাড়া তার অনেক সমকক্ষ ও অংশীদার গ্রহণ করে তাদেরকে আল্লাহর মত ভালবাসে, আর যারা ঈমান এনেছে তারা আল্লাহকে অত্যন্ত বেশি ভালবাসে”। [সূরা আল-বাকারা: ১৬৫]
আল্লাহ আরও বলেন: “হে ইমানদারগণ তোমাদের থেকে যদি কেহ তার দীনকে পরিত্যাগ করে তবে আল্লাহ এমন এক গোষ্ঠীকে তোমাদের স্থলাভিষিক্ত করে আনবেন, যাদেরকে আল্লাহ ভালবাসেন এবং তারাও আল্লাহকে ভালবাসেন, যারা মুমিনদের প্রতি নরম— দয়াপরবশ, কাফেরদের উপর কঠোরতা অবলম্বনকারী; তারা আল্লাহর রাস্তায় জিহাদ করবে, কোন নিন্দুকের নিন্দাকে ভয় করে না।” [সূরা আল মায়েদা: ৫৪]
তেমনিভাবে হাদিস শরিফে আনাস রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত আছে তিনি বলেন: রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন: “যার মধ্যে তিনটি বস্তুর সমাহার ঘটেছে সে ঈমানের স্বাদ পেয়েছে: (এক) তার কাছে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের মহব্বত বা ভালবাসা অন্য সব-কিছু থেকে বেশি হবে। (দুই) কোনো লোককে শুধুমাত্র আল্লাহর উদ্দেশ্যে ভালবাসবে। (তিন) কুফরি থেকে আল্লাহ তাকে মুক্তি দেয়ার পর সে কুফরির দিকে ফিরে যাওয়াকে আগুনে নিক্ষিপ্ত হওয়ার মত অপছন্দ করবে।”[9] 

ষষ্ঠ শর্ত:
 কালেমার হকসমূহ মনে প্রাণে মেনে নেয়া। এর দলীল:
আল্লাহর বাণী: “আর তোমরা তোমাদের প্রভুর দিকে ফিরে যাও, এবং তাঁর কাছে আত্মসমর্পণ করো।” [সূরা আয্‌-যুমার: ৫৪]
আল্লাহ আরও বলেন: “আর তারচেয়ে কার দীন বেশি সুন্দর যে আল্লাহর জন্য নিজেকে সমর্পণ করেছে, এমতাবস্থায় যে, সে মুহসিন”, [সূরা আন্‌-নিসা: ১২৫] মুহসিন অর্থ: নেককার, অর্থাৎ নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর সুন্নত অনুযায়ী আমল করেছে।
আরও বলেন: “আর যে নিজেকে শুধুমাত্র আল্লাহর দিকেই নিবদ্ধ করে আত্মসমর্পণ করেছে আর সে মুহসিন”, অর্থাৎ নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর সুন্নত অনুযায়ী আমল করেছে, “সে মজবুত রশিকে আঁকড়ে ধরেছে” [সূরা লুকমান: ২২] অর্থাৎ: لا إله إلا الله বা আল্লাহ ছাড়া কোন হক মাবুদ নেই এ কালেমাকেই সে গ্রহণ করেছে।
আরও বলেন: “তারা যা বলছে তা নয়, তোমার প্রভুর শপথ করে বলছি, তারা কক্ষনো ইমানদার হবে না যতক্ষণ আপনাকে তাদের মধ্যকার ঝগড়ার নিষ্পত্তিকারক (বিচারক) হিসাবে না মানবে, অতঃপর আপনার বিচার-ফয়সালা গ্রহণ করে নিতে তাদের অন্তরে কোন প্রকার অভিযোগ থাকবে না এবং তারা তা সম্পূর্ণ কায়মনোবাক্যে নির্দ্বিধায় মেনে নিবে।” [সূরা আন্‌-নিসা: ৬৫]

অনুরূপভাবে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন:“তোমাদের মাঝে কেউই ঐ পর্যন্ত ইমানদার হতে পারবেনা যতক্ষণ তার প্রবৃত্তি আমি যা নিয়ে এসেছি তার অনুসারী হবে।”[10] আর এটাই পূর্ণ আনুগত্য ও তার শেষ সীমা।

সপ্তম শর্ত: 
কালেমাকে গ্রহণ করা। এর দলীল:
আল্লাহ তা‘আলা বলেন: “আর এমনিভাবে যখনই আপনার পূর্বে আমি কোন জনপদে ভয় প্রদর্শনকারী (রাসূল বা নবী) প্রেরণ করেছি তখনি তাদের মধ্যকার আয়েশি বিত্তশালী লোকেরা বলেছে: আমরা আমাদের বাপ-দাদাদেরকে একটি ব্যবস্থায় পেয়েছি, আমরা তাদেরই পদাঙ্ক অনুসরণ করবো। (ভয় প্রদর্শনকারী) বলল: আমি যদি তোমাদের কাছে বাপ-দাদাদেরকে যার উপর পেয়েছ তার থেকে অধিক সঠিক বা বেশি হেদায়েত নিয়ে এসে থাকি তারপরও (তোমরা তোমাদের বাপ-দাদার অনুকরণ করবে)? তারা বলল: তোমরা যা নিয়ে এসেছ আমরা তা গ্রহণ করতে অস্বীকার করছি, ফলে আমি (আল্লাহ) তাদের থেকে (এ কুফরির) প্রতিশোধ নেই, সুতরাং আপনি মিথ্যা প্রতিপন্নকারীদের পরিণাম-ফল কেমন হয়েছে দেখে নিন।”[সূরা আয্‌-যুখরুফ: ২৩-২৫]
আল্লাহ তা‘আলা আরও বলেন: “নিশ্চয়ই তারা অযথা ঔদ্ধত্য প্রদর্শন করত যখন তাদেরকে বলা হত যে, আল্লাহ ছাড়া কোন হক মা’বুদ নেই, এবং বলতো: আমরা কি পাগল কবির কথা শুনে আমাদের উপাস্য দেবতাগুলোকে ত্যাগ করবো?” [সূরা আস্‌-সাফ্‌ফাত: ৩৫-৩৭]
অনুরূপভাবে হাদিসে শরিফে আবু মুসা আশ‘আরি রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু বর্ণনা করেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন:
“আল্লাহ আমাকে যে জ্ঞান বিজ্ঞান ও হেদায়েত দিয়ে পাঠিয়েছেন তার উদাহরণ হচ্ছে এমন মুষলধারার বৃষ্টির মতো যা ভূমিতে এসে পড়েছে, ফলে এর কিছু অংশ এমন উর্বর পরিষ্কার ভূমিতে পড়েছে যে ভূমি পানি চুষে নিতে সক্ষম, ফলে তা পানি গ্রহণ করেছে এবং তা দ্বারা ফসল ও তৃণলতার উৎপত্তি হয়েছে। আবার তার কিছু অংশ পড়েছে গর্তওয়ালা ভূমিতে (যা পানি আটকে রাখতে সক্ষম) সুতরাং তা পানি সংরক্ষণ করতে সক্ষম হয়েছে, ফলে আল্লাহ এর দ্বারা মানুষের উপকার করেছেন তারা তা পান করেছে, ভূমি সিক্ত করিয়েছে এবং ফসলাদি উৎপন্ন করতে পেরেছে। আবার তার কিছু অংশ পড়েছে এমন অনুর্বর সমতল ভূমিতে যাতে পানি আটকে থাকে না, ফলে তাতে পানি আটকা পড়ে নি, ফসলও হয় নি। ঠিক এটাই হলো ঐ ব্যক্তির দৃষ্টান্ত যে আল্লাহর দীনকে বুঝতে পেরেছে এবং আমাকে যা দিয়ে পাঠিয়েছেন তা থেকে উপকৃত হতে পেরেছে, ফলে সে নিজে জেনেছে এবং অপরকে জানিয়েছে (প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির ভূমি) এবং ঐ ব্যক্তির উদাহরণ যে এই হিদায়েত এবং জ্ঞান বিজ্ঞানের দিকে মাথা উঁচু করে তাকায় নি, ফলে আল্লাহ যে হিদায়েত নিয়ে আমাকে প্রেরণ করেছেন তা গ্রহণ করেনি। (তৃতীয় শ্রেণির ভূমি)।”[11]



[1] মুসলিম: (১/৫৫), হাদিস নং-২৬।
[2] মুসলিম: (১/৫৬), হাদিস নং-২৭০।
[3] মুসলিম (১/৫৬), হাদিস নং-২৭০।
[4] মুসলিম (১/৫৯)।
[5] বুখারি, হাদিস নং-৯৯।
[6] বুখারি, হাদিস নং-৪২৫; মুসলিম (১/৪৫৬), হাদিস নং- ২৬৩।
[7] নাসায়ি, আমালুল ইয়াওমে ওয়াল্লাইলা, হাদিস নং- ২৮।
[8] বুখারি, হাদিস নং-১২৮; মুসলিম: (১/৬১)।
[9] বুখারি, হাদিস নং-৪৩; মুসলিম: (১/৬৬)।
[10] হাদিসটি খতিব বাগদাদি তার তারিখে বাগদাদের ৪/৩৬৯, এবং বাগাভি তার শারহুস্‌সুন্নাহ্‌ -এর ১০৪ নং -এ বর্ণনা করেছেন। হাদিসটির সনদ শুদ্ধ হওয়ার ব্যাপারে মতভেদ আছে।
[11] সহিহ বুখারি (১/১৭৫) হাদিস নং-৭৯; সহিহ মুসলিম, হাদিস নং ২২৮২।


গ্রন্থনা: শাইখ আব্দুল্লাহ ইব্‌ন ইবরাহীম আল কার‘আওয়ী
অনুবাদ: ড. আবু বকর মুহাম্মাদ যাকারিয়া
সম্পাদনা: ড. মোহাম্মদ মানজুরে ইলাহী
------------------

শাবান মাসের বিশেষ আমল

 Image result for ramadan






শাবান মাসের বিশেষ আমল

মুফতি মুহাম্মদ মর্তুজা

পবিত্র মাহে রমজানের আগমনী বার্তা নিয়ে বিশ্ব মুসলিমের মাঝে হাজির হলো পবিত্র শাবান মাস। সর্বশ্রেষ্ঠ মাস রমজানের আগাম প্রস্তুতির তাগিদ ও শবেবরাতের উপহার নিয়ে এলো বরকতময় শাবান মাস। খোদ শাবান মাসটিও বিভিন্নভাবে বিশেষ গুরুত্ব ও তাত্পর্য রাখে। এ মাসকেই রাসুল (সা.) ‘শাবানু শাহরি’ (শাবান আমার মাস) বলে অভিহিত করেছিলেন। তিনি শাবান মাস থেকেই রমজানের প্রস্তুতি নেওয়া শুরু করতেন। রজব ও শাবানজুড়েই তিনি রমজানের অধীর অপেক্ষায় থাকতেন। এরই ধারাবাহিকতায় রজবের শুরু থেকেই রাসুল (সা.) দোয়া করতেন, ‘আল্লাহুম্মা বারিক লানা ফি রজাবা ওয়া শাবান, ওয়া বাল্লিগনা রমাজান।’ (শুআবুল ইমান : ৩৫৩৪) রমজানের আগমনের জন্য উদ্গ্রীব হয়ে থাকতেন তিনি। হজরত আয়েশা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুল (সা.) শাবান মাসের (দিন-তারিখের হিসাবের) প্রতি এত অধিক লক্ষ রাখতেন, যা অন্য মাসের ক্ষেত্রে রাখতেন না। (আবু দাউদ : ২৩২৫) স্বীয় উম্মতকেও তিনি শাবান মাসের দিন-তারিখের হিসাব রাখার জন্য বিশেষ গুরুত্ব দিতেন।

তিনি এ মাসে অধিক হারে নফল রোজা রাখতেন। হজরত উম্মে সালমা (রা.) বলেন, আমি হজরত মুহাম্মদ (সা.)-কে শাবান ও রমজান মাস ছাড়া অন্য কোনো দুই মাস একাধারে রোজা রাখতে দেখিনি। (আবু দাউদ, হাদিস : ২৩৩৬) 
হজরত আয়েশা (রা.) সূত্রে বর্ণিত, একটি বর্ণনায় তিনি বলেন, আমি নবী করিম (সা.)-কে শাবান মাসের মতো এত অধিক (নফল) রোজা আর অন্য কোনো মাসে রাখতে দেখিনি। এ মাসের অল্প কয়েক দিন ছাড়া বলতে গেলে সারা মাসই তিনি রোজা রাখতেন। (তিরমিজি, হাদিস : ৭৩৭)

অন্য হাদিসে ইরশাদ হয়েছে, হজরত আনাস (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, একবার রাসুল (সা.)-কে জিজ্ঞেস করা হলো, রমজানের পরে কোন মাসের রোজা সবচেয়ে বেশি ফজিলতপূর্ণ? উত্তরে তিনি বলেন, শাবানের রোজা—রমজানের সম্মানার্থে। (তিরমিজি, হাদিস : ৬৬৩)

এ ছাড়া আল্লাহ রাব্বুল আলামিন আমাদের এ মাসে অত্যন্ত ফজিলতপূর্ণ একটি রাত উপহার দিয়েছেন। কোরআনের ভাষায় এটাকে লাইলাতুম মুবারক ও আমাদের এ অঞ্চলের পরিভাষায় ‘শবেবরাত’ বলে অভিহিত করা হয়। বিভিন্ন হাদিসে এ রাতের ফজিলতের বিস্তারিত আলোচনা এসেছে। হজরত মুয়াজ ইবনে জাবাল (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেন, আল্লাহ তাআলা অর্ধ শাবানের রাতে (শাবানের চৌদ্দ তারিখ দিবাগত রাতে) সৃষ্টির দিকে (রহমতের) দৃষ্টি দেন এবং মুশরিক ও বিদ্বেষ পোষণকারী ব্যতীত সবাইকে ক্ষমা করে দেন। (সহিহ ইবনে হিব্বান, হাদিস : ৫৬৬৫)

বিশুদ্ধ মতানুসারে শবেবরাত ও শবেকদরের নফল আমলগুলো একাকী করণীয়। ফরজ নামাজ অবশ্যই মসজিদে জামাতের সঙ্গে আদায় করতে হবে। এরপর যা কিছু নফল পড়ার তা নিজ নিজ ঘরে একাকী পড়বে। বিভিন্ন হাদিস থেকে এ রাতে দীর্ঘ নামাজ পড়া, সিজদা দীর্ঘ হওয়া, দোয়া-ইস্তেগফার করার সুস্পষ্ট প্রমাণ রয়েছে। (শুআবুল ইমান, বায়হাকি : ৩/৩৮২, ৩৮৩)

তবে এসব নফল আমলের জন্য দলে দলে মসজিদে এসে সমবেত হওয়ার প্রমাণ হাদিস শরিফেও নেই, আর সাহাবায়ে কেরামের যুগেও এর রেওয়াজ ছিল না। তবে হ্যাঁ, যদি কোনো প্রকার ঘোষণা বা আহ্বান ছাড়া কয়েকজন মানুষ মসজিদে একত্রিত হয়ে যায়, তবে তারা একাকী ইবাদত করবে। এক শ্রেণির যুবক আছে, এ রাতে বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে রাস্তায় সময় কাটায় উচ্চস্বরে জিকির করে—এগুলো সম্পূর্ণ বর্জনীয়। কারণ এতে করে কোনো রোগাক্রান্ত ব্যক্তির কষ্ট হতে পারে। আর নফল ইবাদত অন্যকে কষ্ট দিয়ে করার কোনো বিধান নেই।

১৫ শাবানের রোজা
শাবান মাসজুড়ে রোজা রাখার বিশেষ ফজিলতের কথা হাদিস শরিফে রয়েছে। এ ছাড়া ‘আইয়ামে বিজ’ তথা প্রতি মাসের ১৩, ১৪ ও ১৫ তারিখে রোজা রাখার ব্যাপারেও হাদিস শরিফে উৎসাহিত করা হয়েছে। এর সঙ্গে সঙ্গে দুর্বল সূত্রে বর্ণিত একটি হাদিসে বিশেষভাবে ১৫ তারিখে রোজা রাখার নির্দেশনাও পাওয়া যায়। হজরত আলী (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেন, ‘১৫ শাবানের রাত (১৪ তারিখ দিবাগত রাত) যখন আসে, তখন তোমরা তা ইবাদত-বন্দেগিতে কাটাও এবং পরদিন রোজা রাখো।’ (সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদিস : ১৩৮৪)

মুসলমানদের হাতেই বিশ্বের প্রথম বিশ্ববিদ্যালয়

মুসলমানদের হাতেই বিশ্বের প্রথম বিশ্ববিদ্যালয়

মাওলানা সাখাওয়াত উল্লাহ

Image result for University of Karueein     মরক্কোর কারাওইন বিশ্ববিদ্যালয়, ইউনেস্কো স্বীকৃত বিশ্বের প্রথম বিশ্ববিদ্যালয়। ফাতেমা নামের একজন মুসলিম নারী ৮৫৯ খ্রিস্টাব্দে এটি প্রতিষ্ঠা করেন


বিশ্ববিদ্যালয় শব্দটির উদ্ভব হয়েছে লাতিন Universitas Magistrorum et Scholarium থেকে। যার অর্থ শিক্ষক ও পণ্ডিতদের সম্প্রদায়। বিদ্যালয় শব্দটির সঙ্গে বিশ্ব শব্দটি যোগ করার অর্থ হলো, এই বিদ্যাপীঠ কোনো একটি নির্দিষ্ট দেশ বা জাতির জন্য নয়। এটি সারা বিশ্বের জন্য। এখানে সারা বিশ্বের যেকোনো দেশের মানুষ পড়তে ও পড়াতে পারবে। বর্তমানে পৃথিবীতে লাখো ইউনিভার্সিটি আছে। কিন্তু কোনটি পৃথিবীর প্রথম বিশ্ববিদ্যালয়, তা নিয়ে কয়েকটি অভিমত পাওয়া যায়।

চীনাদের দাবি হচ্ছে, পৃথিবীর প্রাচীনতম বিশ্ববিদ্যালয় হলো চীনের সাংহাই হায়ার স্কুল। এই বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়েছে খ্রিস্টপূর্ব ২২৫৭ সালে। অল্পকাল পরেই এটি বন্ধ হয়ে যায়। পরবর্তী সময়ে আরো একটি বিশ্ববিদ্যালয় চীনের ঝু ডায়নাস্টির দ্বারা প্রতিষ্ঠিত হয়। প্রতিষ্ঠানটির নাম ইম্পেরিয়াল কেন্দ্রীয় বিদ্যালয় (Imperial Central School)। খ্রিস্টপূর্ব ১০৪৬ সালে এটি প্রতিষ্ঠিত হয়। এটি টিকেছিল ২৪৯ বছর পর্যন্ত।

পাকিস্তানিদের দাবি হলো, পৃথিবীর প্রথম বিশ্ববিদ্যালয় হলো পাকিস্তানের তক্ষশীলা বিশ্ববিদ্যালয়। আজ থেকে দুই হাজার ৭০০ বছর আগে এটি প্রতিষ্ঠিত হয়। বেবিলন, গ্রিস, সিরিয়া, পারস্য, আরব, চীনসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ থেকে ছাত্ররা এখানে ভিড় করত। প্রতিকূল যোগাযোগব্যবস্থা, অমসৃণ পথের দুঃসহ যন্ত্রণা আর পথে মৃত্যুভয় উপেক্ষা করে উচ্চশিক্ষার হিরণ্ময় সাফল্য লাভের আশায় জ্ঞানপিপাসুদের মেলা বসত এখানে। সারা বিশ্ব থেকে ১০ হাজার ৫০০ জন ছাত্র উচ্চতর গবেষণার জন্য আসতেন এই বিশ্ববিদ্যালয়ে। এই বিশাল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের নাম তক্ষশীলা বিশ্ববিদ্যালয়। বর্তমান পাকিস্তানের রাওয়ালপিণ্ডি জেলায় ছিল এই বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থান। পাকিস্তানের বর্তমান রাজধানী ইসলামাবাদ থেকে মাত্র ৩২ কিলোমিটার দূরে এটি অবস্থিত। তার ধ্বংসাবশেষ এখনো সেখানে রক্ষিত আছে।
পণ্ডিত ব্যক্তিরা অবশ্য এটাকে বিশ্ববিদ্যালয়ের মাপকাঠিতে স্বীকৃতি দিতে নারাজ। তাদের দাবি হলো, তক্ষশীলা শিক্ষালয়টি বর্তমানের বিভিন্ন ক্যাটাগরির বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ নয়। বিশ্ববিদ্যালয় বলতে সাধারণত আমাদের চোখে ভেসে ওঠে কোনো একটি একক উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান। যেটি পরিচালিত হয় সুনির্দিষ্ট নীতিমালা দিয়ে। কিন্তু তক্ষশীলার ক্ষেত্রে তা যায় না। এখানে  শিক্ষকরা ছিলেন স্বাধীন। যে যাঁর মতো পাঠদান করতেন। তাঁরা খণ্ড খণ্ড বিভাগের দায়িত্ব থেকে নিজ নিজ সিদ্ধান্ত অনুযায়ী বিভাগের শিক্ষা কার্যক্রম ও পাঠ্যসূচি পরিচালনা করতেন।  তক্ষশীলাকে বিশ্ববিদ্যালয় বিবেচনা করা যায় কি না, তা নিয়ে বিজ্ঞ মহলে যুক্তি-পাল্টা যুক্তির তীর নিক্ষেপ চললেও তক্ষশীলা যে উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান ছিল, সে বিষয়ে সবাই একমত।

এদিকে ভারতীয়দের দাবি হলো, বিশ্বের প্রথম বিশ্ববিদ্যালয় হচ্ছে ভারতের বিহারের রাজগিরের নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়। ইতিহাসের নানা ঘাত-প্রতিঘাতে সময়ের ব্যবধানে এই বিশ্ববিদ্যালয়ও একসময় বন্ধ হয়ে যায়। জানা গেছে, বিশ্ববিদ্যালয়টি সর্বপ্রথম ৪৫৫ থেকে ৪৬৭ সাল পর্যন্ত বন্ধ থাকে। পরে দ্বিতীয় দফায় ৬০০ সালে বন্ধ হয়ে ৬৬৮ সালে পুনরায় চালু হয়।

কিন্তু ১১৯৩ সালে এটি স্থায়ীভাবে বন্ধ হয়ে যায়। ৮২১ বছর পর সেই নালন্দার দরজা ফের খুলেছে ২০১৪ সালের ১ সেপ্টেম্বর সোমবার। মাত্র দুটি বিভাগে ১১ জন শিক্ষক ও ১৫ শিক্ষার্থী নিয়ে নতুনভাবে যাত্রা শুরু করেছে নালন্দা। নালন্দাকে নিয়ে গর্ব করার অনেক কিছুই ছিল। এখানে দুই হাজার শিক্ষক ও ১০ হাজার ছাত্র ছিল। নালন্দা মূলত বৌদ্ধ ধর্মের শিক্ষা ও গবেষণার জন্য নির্মিত হয়েছে। পরে সেখানে হিন্দু ধর্মচর্চা শুরু হয়।
এসব মত-দ্বিমত পেছনে রেখে মুসলমানরা দাবি করে, পৃথিবীতে তারাই সর্বপ্রথম বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেছে। আন্তর্জাতিকভাবে  গ্রহণযোগ্য দলিল-দস্তাবেজ মুসলমানদের পক্ষে। গিনেস বুকের রেকর্ড অনুসারে মরক্কোর ফেজ নগরীর কারাওইন বিশ্ববিদ্যালয় পৃথিবীর প্রথম বিশ্ববিদ্যালয়।
http://www.guinnessworldrecords.com/world-records/oldest-university

জাতিসংঘ শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতি সংস্থা (United Nations Educational, Scientific and Cultural Organization) বা ইউনেস্কো (UNESCO)-এর ঘোষণা মতেও কারাওইন বিশ্ববিদ্যালয় পৃথিবীর প্রথম বিশ্ববিদ্যালয়। 
(A History of the University in Europe. Vol. I : Universities in the Middle Ages, Cambridge University Press, 2003, ISBN 978-0-521-54113-8, pp. 35–76 (35)

মরক্কোর ফেজ নগরীর এই প্রাচীনতম বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয় ৮৫৯ খ্রিস্টাব্দে। ১৯৬০ সালে বিশ্ববিদ্যালয়টির ১১০০তম বর্ষপূর্তি ঘটে। এই বিশ্ববিদ্যালয় চালুর সময় ছিল ইসলামের সোনালি যুগ। নবম শতাব্দীর প্রথম দিকে ফেজ নগরী ছিল অনেকটা গ্রামসদৃশ। তখন মরক্কোর শাসক আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করেছিলেন : ‘হে আল্লাহ! আপনি এ নগরীকে আইন ও বিজ্ঞানের কেন্দ্র হিসেবে কবুল করুন।’ সে স্বপ্ন পূরণের লক্ষ্যে ফেজ নগরীর এক বিধবা ধনাঢ্য মহীয়সী নারী চালু করেন কারাওইন মসজিদ। কারাওইন বিশ্ববিদ্যালয় ৮৫৯ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় মসজিদের অংশ হিসেবে। এর প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন ফাতিমা আল ফিহরি নামের এক মহীয়সী নারী। তাঁর বাবা ছিলেন ফেজ নগরীর ধনাঢ্য ব্যবসায়ী মুহাম্মদ আল ফিহরি। আল ফিহরি পরিবার ফেজে আসেন নবম শতাব্দীর প্রথম দিকে। তাঁরা এখানে আসেন তিউনিসিয়ার কারাওইন থেকে। সে সূত্রে এ বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম রাখা হয় কারাওইন বিশ্ববিদ্যালয়। তাদের সঙ্গে কারাওইন থেকে তাঁদের সমাজের বেশ কিছু লেখক ফেজে এসে নগরীর পশ্চিমের অংশে বসবাস শুরু করেন। ফাতিমা আল ফিহরি ও তাঁর বোন মরিয়ম আল ফিহরি উভয়েই ছিলেন সুশিক্ষিত। তাঁরা উত্তরাধিকার সূত্রে পিতার কাছ থেকে প্রচুর অর্থসম্পদ পান। ফাতিমা তাঁর অংশের সব অর্থ খরচ করেন তাঁর সমাজের লেখকদের জন্য একটি মসজিদ তৈরির পেছনে।

কেবল ইবাদতের স্থান না হয়ে এই মসজিদ শিগগিরই হয়ে ওঠে ধর্মীয় নির্দেশনা ও রাজনৈতিক আলোচনার স্থল। মসজিদটি পুরোপুরি নির্মাণ করতে সময় লেগে যায় ২৭৮ বছর।  ইতালির বোলোনা (Bologna)-য় যখন প্রথম ইউরোপীয় বিশ্ববিদ্যালয় ্রপ্রতিষ্ঠিত হয়, তারও আগে কারাওইন হয়ে ওঠে এক বিশ্বখ্যাত বিশ্ববিদ্যালয়। বলতে আপত্তি কোথায়, সভ্য দুনিয়াকে লেখাপড়া শিখিয়েছে মুসলমানরা! শুরুতে এটি ছিল ধর্মীয় শিক্ষাকেন্দ্র। পরে সেখানে ধর্মীয় শিক্ষা বাধ্যতামূলক করে জাগতিক বিষয় পড়ানো শুরু করা হয়। অচিরেই এর ছাত্রসংখ্যা দাঁড়ায় আট হাজারে।  তাঁরা সেখানে চিকিৎসাবিদ্যা থেকে শুরু করে ইতিহাস-ভূগোলসহ অনেক বিষয়েই উচ্চশিক্ষা লাভ করতে থাকেন। ফেজকে তখন বলা হতো ‘পাশ্চাত্যের বাগদাদ’—‘বাগদাদ অব দ্য ওয়েস্ট’।

ইউরোপের মহাজাগরণের মধ্য দিয়ে মুসলমানদের সোনালি যুগের অবসান ঘটে। মধ্য-অষ্টাদশ শতাব্দী পর্যন্ত এসে দেখা গেল, কারাওইন ছেড়ে গেছেন জ্ঞানী-গুণী আর বিজ্ঞানীরা। সেখানে অবশেষ রইল কেবল ধর্মীয় শিক্ষাব্যবস্থা। ১৯১২-৫৬ সময়ে মরক্কো ছিল ফ্রান্সের প্রটেক্টরেট। সে সময় বিশ্ববিদ্যালয়টি ধ্বংসের মুখোমুখি এসে দাঁড়ায়। ইসলাম ও মুসলমানদের বিরুদ্ধে ইউরোপের ষড়যন্ত্রের বলি হয় এই ঐতিহ্যবাহী প্রতিষ্ঠান। সে সময় সেখানে পরীক্ষা ও ডিগ্রি দেওয়া বন্ধ করে দেওয়া হয়। ছাত্রদের থাকতে হয় আলোহীন-বায়ুহীন প্রকোষ্ঠে, জানালাহীন কক্ষে।

১৯৫৬ সালে মরক্কো স্বাধীন হয়। জাতিকে বিংশ শতাব্দীর উপযোগী করে গড়ে তোলার দৃঢ়তা নিয়ে বাদশাহ মুহাম্মদ কারাওইন বিশ্ববিদ্যালয়ে আবার চালু করেন গণিত, পদার্থবিদ্যা, রসায়নবিদ্যা, বিদেশি ভাষাবিষয়ক পাঠক্রম। ১৯৫৭ সালে তিনি কারাওইনে চালু করেন মহিলা শাখা। কারাওইন বিশ্ববিদ্যালয় এখন মুসলিম বিশ্বের অন্যতম এক ধর্মীয় ও জাগতিক শিক্ষাকেন্দ্র। এই বিশ্ববিদ্যালয় মধ্যযুগের মুসলমান ও ইউরোপীয়দের মধ্যে সাংস্কৃতিক ও শিক্ষাবিষয়ক সম্পর্ক গড়ে তোলার ক্ষেত্রে অনন্য অবদান রাখে। অনেক অমুসলিমও এই বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেন। এই বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্যতম অমুসলিম অ্যালামনি ছিলেন ইহুদি দার্শনিক ও ধর্মতত্ত্ববিদ মুসা বিন মাইমুন বা মাইমোনাইডস (১১৩৫-১২০৪)। তিনি শিক্ষা লাভ করেন আবদুল আরব ইবনে মোয়াশাহার তত্ত্বাবধানে। কার্টিওগ্রাফার মুহাম্মদ ইদ্রিসির (মৃত্যু : ১১৬৬) মানচিত্র ইউরোপ অভিযানে ব্যবহার হয়েছিল রেনেসাঁর যুগে। ফেজে এ মানচিত্র দীর্ঘদিন সংরক্ষিত ছিল। এই বিশ্ববিদ্যালয় সৃষ্টি করেছে অসংখ্য জ্ঞানীগুণী, যাঁরা মুসলিম বিশ্বের জ্ঞান-বিজ্ঞান ও শিক্ষার ইতিহাসে ব্যাপক প্রভাব ফেলতে সক্ষম হয়েছেন। তাঁদের মধ্যে ছিলেন ইবনে রুশায়েদ আল সাবতি (মৃত্যু : ১৩২১), মুহাম্মদ ইবনে আলহাজ আলআবদারি আলফাসি (মৃত্যু : ১৩৩৬), শীর্ষস্থানীয় তাত্ত্বিক মালিকি এবং সুপরিচিত পরিব্রাজক ও লেখক লিও আফ্রিকানাস।
প্রথম দিকে এই বিশ্ববিদ্যালয়ে মালেকি মাজহাব অনুসারে ইসলাম ধর্মচর্চা করা হতো। ধীরে ধীরে এই প্রতিষ্ঠানকে রূপ দেওয়া হয় একটি বিশ্বমানের বিশ্ববিদ্যালয়ে। ১৯৫৭ সালে বাদশাহ পঞ্চম মুহাম্মদ সেখানে চালু করেন গণিত, পদার্থবিদ্যা, রসায়নশাস্ত্র ও বিদেশি ভাষা শিক্ষার কোর্স।

এই বিশ্ববিদ্যালয় পৃষ্ঠপোষকতা পেয়েছিল ক্ষমতাধর সুলতানদের কাছ থেকে। প্রতিষ্ঠানটির আরেকটি বৈশিষ্ট্য হলো, এখানে রয়েছে বিশ্বখ্যাত লাইব্রেরি। রয়েছে বিপুলসংখ্যক পাণ্ডুলিপি। ১৩৪৯ সালে সুলতান আবু ইনান ফ্যাবিস একটি লাইব্রেরি প্রতিষ্ঠা করেন। সে লাইব্রেরিতে অসংখ্য মূল্যবান পাণ্ডুলিপি রাখা হয়। আজকের দিনে এই বিশ্ববিদ্যালয়ে যেসব মূল্যবান পাণ্ডুলিপি রয়েছে, সেগুলোর মধ্যে আছে : হরিণের চামড়ার ওপর ইমাম মালেক (রহ.)-এর লেখা মুয়াত্তার পাণ্ডুলিপি, ১৬০২ সালে সুলতান আহমাদ আল মনসুরের দেওয়া কোরআনের কপি, সিরাতে ইবনে ইসহাক, ইবনে খালদুনের বই ‘আল-ইবার’-এর মূল কপি। এই বিশ্ববিদ্যালয়ে অন্যান্য বিষয়ের মধ্যে পড়ানো হতো কোরআন ও ফিকহ (ইসলামী আইনশাস্ত্র), ব্যাকরণ, বক্তৃতাদানবিদ্যা বা অলংকারশাস্ত্র, যুক্তিবিদ্যা, চিকিৎসাবিদ্যা, গণিত, জ্যোতির্বিদ্যা, রসায়নবিদ্যা, ইতিহাস, ভূগোল ও সংগীতবিদ্যা।

মধ্যযুগে কারাওইন মুসলমান ও ইউরোপের মধ্যে সাংস্কৃতিক ও জ্ঞান বিনিময়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। অগ্রণায়ন বিদ্বজ্জন ইবনে মাইমুন (১১৩৫-১২০৪), আল-ইদ্রিসি (মৃত ১১৬৬), ইবনে আরাবি (১১৬৫-১২৪০), ইবনে খালদুন (১৩৩২-১৩৯৫), ইবনে খতিব, আল-বিতরুজি (অ্যালপে ট্রেজিয়াম), ইবনে হিরজিহিম ও আল ওয়্যাজ্জেন এই বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র বা শিক্ষক ছিলেন। যেসব খ্রিস্টান পণ্ডিত এই বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিজিটিং স্কলার ছিলেন, তাঁদের মধ্যে রয়েছেন বেলজিয়ামের নিকোলাস ক্লোনয়ার্টস ও ওলন্দাজ গোলিয়াস। ধারাক্রমে মরক্কোর বিভিন্ন শাসক কারাওইন মসজিদ কমপ্লেক্সের সম্প্রসারণ করেছেন অব্যাহতভাবে। সেখানে ২০ হাজার নামাজি একসঙ্গে নামাজ আদায় করার সুযোগ পান।  শুরুতে মসজিদটির দৈর্ঘ্য ছিল ৩০ মিটার। ছিল একটি প্রাঙ্গণ ও চারটি স্তম্ভপরিবেষ্টিত ঘোরানো গলি। এর প্রথম সম্প্রসারণ হয় ৯৫৬ খিস্টাব্দে। এই সম্প্রসারণের কাজ করান কর্ডোভার উমাইয়া খলিফা তৃতীয় আবদুর রহমান। তখন মসজিদ সম্প্রসারিত করা হয়। মিনার স্থানান্তর করা হয়। তখনকার দিনে ফেজ নগরীতে একটা রেওয়াজ হয়ে দাঁড়িয়েছিল, কারাওইনের মিনার থেকে আজানের আওয়াজ আসার পরপরই নগরীর অন্যান্য মসজিদে আজান শুরু করা হতো। এই মসজিদে সবচেয়ে ব্যয়বহুল পুনর্গঠনের কাজ সম্পন্ন হয় ১১৩৫ খ্রিস্টাব্দে, মুরাবিদ শাসক সুলতান আলী ইবনে ইউসুফের তত্ত্বাবধানে। তিনি আদেশ দেন, মসজিদের স্তম্ভপরিবেষ্টিত ঘোরানো গলি ১৮টি থেকে ২১টিতে উন্নীত করতে হবে। এ সময় এর কাঠামোর সম্প্রসারণ ঘটানো হয় তিন হাজার বর্গমিটার।


লেখক : শিক্ষক, মাদ্রাসাতুল মদিনা
নবাবপুর, ঢাকা

Peace Be Upon You

Peace Be Upon You