Tuesday, April 21, 2015

আল্লাহর কাছে তো তুমি সস্তা নও। আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের কাছে তুমি অনেক মূল্যবান।

রহমান রহীম আল্লাহ্‌ তায়ালার নামে-  



miracle-for-earth

 
আনাস (রাঃ) বলেন, যাহির বিন হারাম (রাঃ) নামক একজন বেদুইন সাহাবী ছিলেন। তিনি কখন মরু এলাকা থেকে মদিনায় এলে রাসুলের জন্য পনির বা ঘি হাদিয়া নিয়ে আসতেন। 
 ফিরে যাবার সময় রাসুল তাকে খেজুর ইত্যাদি হাদিয়া দিয়ে দিতেন। 




রাসুল তাকে খুব ভালবাসতেন। তার সম্পর্কে বলতেন-
‘ যাহির আমাদের মরুপ্রান্তর, আর আমরা তার শহর।’

যাহির বিন হারাম (রাঃ) দেখতে তেমন সুশ্রী ছিলেন না।
একদিন তিনি মরু এলাকা থেকে রাসুল এর কাছে এলেন। কিন্তু তিনি রাসুল কে বাড়িতে পেলেন না। তার সাথে কিছু পণ্যদ্রব্য ছিল। বিক্রয় এর জন্য সেগুলো নিয়ে তিনি বাজারে চলে গেলেন।
এদিকে রাসুল বাড়ি ফিরে যাহিরের কথা জানতে পেরে তার খোঁজে নিজেই বের হয়ে গেলেন। বাজারে গিয়ে দেখলেন, যাহির(রাঃ) একমনে তার পণ্যদ্রব্য বিক্রয় করছে। তার শরীর থেকে ঘাম ঝরছে। সে ঘামে শরীরের কাপড়-চোপড় ভিজে জবজব করছে। তার কাপড় থেকে ঘামের গন্ধ ভেসে আসছে। রাসুল তাকে দেখেছিলেন। যাহির(রাঃ) কিন্তু রাসুলকে দেখতে পেলেন না।
রাসুলধীরে ধীরে এগিয়ে গিয়ে যাহির(রাঃ) এর পেছন থেকে জরিয়ে ধরলেন।
যাহির (রাঃ) চমকে ওঠলেনতিনি বুঝতে পারলেন না, কে তাকে এভাবে ধরেছে। যাহির (রাঃ) ঘাবড়ে গিয়ে বললেন, ‘ আমাকে ছেড়ে দিন বলছি। কে আপনি। ’
রাসুলনিশ্চুপ থাকলেন।
যাহির নিজেকে ছাড়াতে প্রাণপণ চেষ্টা করতে লাগলেন। 
হঠাৎ তিনি পিছনের দিকে ফিরে তাকালেন। রাসুল কে একপলক দেখেই তার হৃদয়রাজ্য প্রশান্তির ঢেউ খেলে গেল।
এরপর তিনি নিজের পিঠকে রাসুলএর পবিত্র বুকের সঙ্গে মিলিয়ে রাখলেন। রাসুলযাহিরের সঙ্গে আরেকটু রসিকতা করতে চাইলেন। তিনি জোরে জোরে বলতে লাগলেন, এ গোলামটি কে কিনবে ? কে কিনবে এ গোলামটিকে? ’  রাসুলএর কথা শুনে যাহির রাঃ নিজেকে নিয়ে একটু ভাবলেন। চোখ বন্ধ করে যাহির দেখতে পেলেন সে একজন গরিব ও গ্রাম্য বেদুইন। ধন দৌলত বলতে কিছু নেই। চেহারায় নেই কোন শ্রী। তাই নিজেকে খুব মূল্যহীন মনে হলো তার।

এরপর যাহির (রাঃ) বলে ওঠলেন, হে আল্লাহর রাসুল ! এ গোলামটাকে তো অনেক সস্তায় বিক্রি করতে হবে।
রাসুলবললেন-
“ কিন্তু আল্লাহর কাছে তো তুমি সস্তা নও। আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের কাছে তুমি অনেক মূল্যবান।” 
( ইবনে হিব্বান)
এমন আন্তরিকতাপূর্ণ আচরণ পেলে কারো মন রাসুলএর জন্য যদি পাগল হয়ে যায় তাহলে এতে আশ্চর্যের কি আছে ?

 Reference: Enjoy Your Life by Shaikh Dr. Muhammad ibn Abdur Rahman Al-’Arifi. Page- 44

English version 


(সম্পাদিত)

Saturday, April 18, 2015

তিনস্তরের ছাঁকনী

ঘটনাটি আব্বাসীয় খিলাফার স্বর্ণযুগের সময়কার। মুসলিম সালতানাতের রাজধানী বাগদাদে বাস করতেন এক জ্ঞানী ব্যক্তি যিনি তাঁর অসাধারণ জ্ঞানের জন্য সুপরিচিত ছিলেন।
একদিন তাঁর পরিচিত এক লোক তাঁর সাথে দেখা করতে এসে বলতে লাগলো, জানেন, এইমাত্র আপনার বন্ধু সম্পর্কে আমি কী শুনেছি?
জ্ঞানী লোকটি বললেন, দাঁড়াও। কোনো কিছু বলার আগে আমি চাই তুমি একটি ছোট্ট পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হও। পরীক্ষাটির নাম তিনস্তরের ছাঁকনী পরীক্ষা।
তিনস্তরের ছাঁকনী?
ঠিক তাই, জ্ঞানী লোকটি বলতে লাগলেন, আমার বন্ধু সম্পর্কে কোনো কিছু বলার আগে তুমি যা বলতে চাও তা একটু পরীক্ষা করে নিলে খুব ভালো হবে।
সে কারণেই আমি একে তিনস্তরের ছাঁকনী পরীক্ষা বলে ডাকি।
প্রথম স্তর হচ্ছে সত্য। তুমি কী এ ব্যাপারে নিশ্চিত যে যা বলতে চাইছো তা পুরোপুরি সত্য?
নাহ্‌, লোকটি বললো, আসলে আমি বিষয়টি সম্পর্কে এইমাত্র জেনেছি এবং...

ঠিক আছে, জ্ঞানী লোকটি বললেন, অর্থাৎ তুমি এ ব্যাপারে নিশ্চিত নও যে ঘটনাটি পুরোপুরি সত্য কিনা।
এবার দ্বিতীয় স্তরে যাওয়া যাক। আর এই স্তরটি হলো কল্যাণ। আমার বন্ধু সম্পর্কে তুমি যা কিছু বলতে চাইছো তার মাঝে কী কোনো কল্যাণ রয়েছে?
নাহ্‌, বরং তা...
জ্ঞানী লোকটি বললেন, অর্থাৎ তার সম্পর্কে তুমি এমন কিছু বলতে চাইছো যাতে কোনো কল্যাণ নেই, এমনকি তার সত্যতা সম্পর্কেও তুমি নিশ্চিত নও। তারপরও তুমি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে পারো। কারণ এখনো একটি স্তর বাকী রয়েছে। আর এটি হচ্ছে কার্যকারীতা।
তুমি আমার বন্ধু সম্পর্কে যা বলতে চাইছো তা কী আমার কোনো কাজে আসবে?
একেবারেই না।
সবশেষে জ্ঞানী লোকটি বললেন, ভালো কথা। তুমি আমাকে যা বলতে চাইছো তা যদি সত্যই না হয় অথবা তার মাঝে যদি কোনো কল্যাণই না থাকে কিংবা তা যদি আমার কোনো কাজেই না আসে, তবে তুমি কেনইবা আমাকে তা বলতে চাচ্ছো?

মুমিনগণ, কেউ যেন অপর কাউকে উপহাস না করে। কেননা, সে উপহাসকারী অপেক্ষা উত্তম হতে পারে এবং কোন নারী অপর নারীকেও যেন উপহাস না করে। কেননা, সে উপহাসকারিণী অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ হতে পারে। তোমরা একে অপরের প্রতি দোষারোপ করো না এবং একে অপরকে মন্দ নামে ডেকো না। কেউ বিশ্বাস স্থাপন করলে তাদের মন্দ নামে ডাকা গুনাহ। যারা এহেন কাজ থেকে তওবা না করে তারাই যালেম।
[সূরা আল হুজুরাতঃ ১১]


মুমিনগণ, তোমরা অনেক ধারণা থেকে বেঁচে থাক। নিশ্চয় কতক ধারণা গুনাহ। এবং গোপনীয় বিষয় সন্ধান করো না। তোমাদের কেউ যেন কারও পশ্চাতে নিন্দা না করে। তোমাদের কেউ কি তারা মৃত ভ্রাতার মাংস ভক্ষণ করা পছন্দ করবে? বস্তুতঃ তোমরা তো একে ঘৃণাই কর। আল্লাহকে ভয় কর। নিশ্চয় আল্লাহ তওবা কবুলকারী, পরম দয়ালু।
[সূরা আল হুজুরাতঃ ১২]

Main-link: musafirshahid.blogspot.com

Friday, April 17, 2015

মুসলিমদের বিজয় নিয়ে কিছু কথা

শুরু করছি আল্লাহর নামে যিনি পরম করুণাময়, অতি দয়ালু।

577615_524705977592521_1705321180_n

আলহামদুলিল্লাহ, ওয়াস সালাতু ওয়াস সালামু আলা রাসূলিল্লাহ ।
প্রকৃতপক্ষে ‘বিজয়’ শব্দটার মধ্যে এমন একটা উপলব্ধি রয়েছে, যা অন্য কিছুর মধ্যে নেই । এই যেমন নতুন হাটতে শেখা একটা বাচ্চা দৌড়ে গিয়ে তার মা’কে ধরতে পারার মধ্যে যে বিজয়ের আনন্দ পায়, তা কেবল সেই বুঝে । আবার মৃত্যুর পর জান্নাত পাওয়ার আনন্দ কেবল ঐ বিজয়ী (জান্নাতী) ব্যক্তিই বুঝবে । তবে বিজয় শব্দটা ইতিবাচক হলেও প্রায় সময় নেতিবাচক ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হয় । এই যেমন একজন চুর সফলভাবে চুরি সম্পন্ন করাকেও বিজয় মনে করে । তবে নেতিবাচক বিজয় কেবল পৃথিবীতেই সম্ভব । কারণ পরকালে কোন জাহান্নামী ব্যক্তি নিজেকে বিজয়ী বলে দাবি তো করবেই না বরং হতাশায় আচ্ছন্ন হবে ।
আর মুসলিম সম্প্রদায়ের বিজয়টা খুব সহজ । কারণ এর রূপ রেখা স্বয়ং আল্লাহ তা’আলা নির্ধারণ করে দিয়েছেন এবং মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তা বাস্তবায়ন করে দেখিয়েছেন । তাই এই সহজ বিজয়টা কেন কঠিন করে ফেলবো ? তাহলে আসুন সংক্ষেপে জেনে নেই মুসলিমদের বিজয় মূহর্তগুলো কেমন হতে পারে-
● কে হবে নেতা ?
“মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হলেন আল্লাহর বান্দা ও রাসূল । তাঁকে পৃথিবীতে প্রেরণ করা হয়েছে এক সুন্দর ও সুদৃঢ় জীবন ব্যবস্থাসহ সুন্দর ও সরল পথের সন্ধান দিয়ে । তিনি সৃষ্টিকুলের সেরা ও মুত্তাকীনদের মহান নেতা । আর তাঁর আগমনের পর জান্নাতে যাওয়ার একমাত্র পথটি কেবল তাঁর দেখানো পথ । অন্য কোন পথ আর উন্মুক্ত নেই ।” – (যাদুল মা’আদ)
[সুতরাং মুসলিমদের বিজয়ের নেতৃত্ব দিবে সেই ব্যক্তিই, যে রাসূলুল্লাহ (সা:) এর দেখানো পথকেই সকল সমস্যা সমাধানের জন্য বেছে নিবে । যেখানে থাকবে না নিজের স্বার্থ রক্ষা কিংবা ক্ষমতা লাভের মিশ্রিত পন্থা]
● কারা হবে ইসলামী নেতার সঙ্গী ?
আল্লাহর উত্তম সৃষ্টি ‘মানবকুল’ দু’ভাগে বিভক্ত । একদল সৎ ও সাধু, অপরটি অসৎ ও কুলষিত । আল্লাহ তা’আলার সাহায্য কেবল সৎ ও সাধু ব্যক্তির উপর নিপতিত হয় । আর এ দৃষ্টিকোণ থেকেই মানুষের মধ্যে কে ভাগ্যবান এবং কে হতভাগ্য তা চিনতে পারা যায় । যে ব্যক্তি আল্লাহর বিচারে ভাগ্যবান, সে ব্যক্তি সবসময়ই নিজেকে পবিত্রতার দিকে রাখবে । সে আল্লাহর ইচ্ছা ও সন্তুষ্টিকে নিজের প্রবৃত্তির উপর স্থান দিবে । ঠিক একইভাবে তাঁর বন্ধু-বান্ধব ও সঙ্গী-সাথীরাও হবে সৎ মানুষ । – (যাদুল মা’আদ)
[একজন আদর্শ ইসলামী নেতার নেতৃত্ব মেনে নেওয়ার সৌভাগ্য কেবল আল্লাহর পক্ষ হতে বাছাইকৃত লোকদেরই হয় । যেমনটি হয়েছিল সাহাবীগণের (রা:) । আর হতভাগ্যদের নেতৃত্বের দায়িত্ব শয়তানের হাতে বর্তায় ।]
● মক্কার সেই দিনগুলো:
মক্কার মুশরিকরা ইসলামের প্রচার ও প্রসারকে থামিয়ে দিতে সেই শুরু থেকেই নানা পরিকল্পনা করে আসছিলো । কখনো রাসূল (সা:) কে যাদুকর, কখনো পাগল অপবাদ দিতো এবং নানারকম ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ করতো । কিন্তু তাঁরা যখন এটা বুঝতে পারলেন যে, তাঁদের ঐ কৌশল ও ব্যবস্থাপনা ইসলামী আন্দোলনের ব্যাপ্তিলাভের বিরুদ্ধে তেমন কার্যকর হচ্ছে না, তখন তাঁরা সকলে পুনরায় এক আলোচনা চক্রে মিলিত হন এবং মুসলিমদের শাস্তি প্রদান ও তাদেরকে ইসলাম থেকে ফিরিয়ে আনার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলেন । সিদ্ধান্ত অনুযায়ী প্রত্যেক গোত্রপতি তার গোত্রের ইসলাম গ্রহণকারীদের শাস্তি প্রদান করা শুরু করে দিলো ।
আবু জাহল যখন কোন সম্ভ্রান্ত বা শক্তিধর ব্যক্তির মুসলিম হওয়ার কথা শুনত তখন সে তাকে ন্যায়-অন্যায় বলে গালি গালাজ করত, অপমান-অপদস্থ করতো এবং ধন-সম্পদের ক্ষয়ক্ষতি করবে বলে ভয় দেখাতো । জ্ঞাতী গোষ্ঠীর যদি কোন দুর্বল ব্যক্তি মুসলিম হতো, তাহলে তাকে সে অত্যন্ত নির্দয়ভাবে মারধোর করত এবং মারধোর করার জন্য অন্যদের প্ররণচিত করত ।
উসমান বিন আফ্ফানের চাচা তাঁকে খেজুর পাতার চাটাইয়ের মধ্যে জড়িয়ে রেখে আগুন লাগিয়ে ধোঁয়া দিতো ।
মুস’আব বিন উমায়ের (রা) এর মা যখন তাঁর (ছেলের) ইসলাম গ্রহণের কথা শুনতে পেল তখন সে তার খানা-পিনা (আহারাদি) বন্ধ করে দিলো এবং তাঁকে বাড়ি থেকে বেড় করে দিলো ।
বিলাল রাদিয়াল্লাহু আনহু, উমাইয়া বিন খালাফ জুমাহীর ক্রীতদাস ছিলেন । তিনি ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করায় উমাইয়া তাঁর গলায় দড়ি বেঁধে ছোকরাদের হাতে ধরিয়ে দিতো । তারা সেই দড়ি ধরে তাঁকে পথে প্রান্তের টেনে হিঁচড়ে নিয়ে বেড়াতো । তাঁকে খানা-পিনা না দিয়ে ক্ষুধার্থ ও পিপাসার্ত রাখতো । এসবের চেয়েও অনেক বেশি কঠিন ও কষ্টকর হতো তখন, যখন দুপুর বেলা প্রখর রৌদ্রে আগুনের মতো উত্তপ্ত কংকর ও বালির মধ্যে শুইয়ে দিয়ে বুকের উপর পাথর চাপা দেয়া হতো । – (আর-রাহীকুল মাখতুম)
[ইসলামের শত্রুরা মুসলিমদের সিংহের চেয়েও বেশি ভয় পায় । তাই সুযোগ পেলেই তারা মুসলিমের উপর চেপে বসে । কিন্তু এই আদর্শের লড়াই মুসলিমরা কখনোই ধৈর্য্যহারা হয় না । কারণ তারা জানে চুড়ান্ত বিজয় তাদেরই এবং এর পুরস্কার স্বয়ং আল্লাহ দিবেন । ]
● মদীনার সেই দিনগুলো:
অশান্তি এবং উপহাসের লক্ষ্য বস্তু থেকে নিষ্কৃতিলাভই শুধু হিজরতের মুখ্য উদ্দেশ্য ছিলো না । বরং এ উদ্দেশ্যও নিহিত ছিলো যে, এক শান্তিপূর্ণ এলাকায় ইসলামী আন্দোলনের জন্য স্বস্তি ও শান্তির বাতাবরণ সৃষ্টি করা । এ কারণে সকল সমর্থ মুসলিমগণের উপর এটা ফরজ করে দেয়া হয়েছিলো যে, এ নতুন দেশ ও নতুন রাষ্ট্রের নির্মাণ কাজে তারা সাধ্যমত অংশগ্রহণ করবেন এবং একে রক্ষণাবেক্ষণ ও মর্যদার উচ্চশিখরে সমাসীন করার ব্যাপারে আপ্রাণ প্রচেষ্টা চালিয়ে যাবেন ।
মদীনাতে সাহাবীগণ (রা:) সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কে যে সব সমস্যার সম্মুখীন হতে হতো তা হচ্ছে- তাদের জন্য মদীনার অবস্থা অবশ্যই মক্কার অবস্থার বিপরীত ছিলো । যদিও তাঁদের দ্বীন সম্পর্কিত ধ্যান ধারণা, লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য অভিন্ন ছিল, কিন্তু মক্কা জীবনে তারা বসবাস করতেন বিচ্ছিন্ন ও বিক্ষিপ্ত অবস্থায় । আর তাঁরা ছিলেন নিরুপায়, অপমানিত ও দুর্বলতর । তারা আত্মিক ও নৈতিক বলে চরম বলীয়ান হলেও লৌকিক শক্তি সামর্থ্য কিংবা ব্যক্তি স্বাধীনতা বলতে তেমন কিছুই ছিলো না । পক্ষান্তরে মদীনার জীবনের প্রথম থেকেই নেতৃত্ব-কর্তৃত্ব ছিলো মুসলিমদের হাতে ।
সময় ও সুযোগ এসেছিল মুসলিমদের জন্য এমন এক জীবন-ধারা প্রবর্তনের যা ছিলো জাহেলিয়াত যুগের জীবন-ধারা থেকে সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র । এমনকি পৃথিবীর কোথাও এমন কোন জীবন ধারা ছিলো না যার সঙ্গে এর কোন তুলনা করা যেতে পারে ।
এই মদীনাতেই রাসূলুল্লাহ (সা:) মসজিদে নববী নির্মাণ করে মুসলিমদের ইবাদাতের একটি স্থায়ী জায়গা নির্ধারণ করেন । অতঃপর মুসলিমদের মধ্যে ভাতৃত্ববোধ সৃষ্টির ব্যাপারেও খুব জোর দেওয়া হয় এই মদীনাতেই । মুসলিমদের এ ভাতৃত্ব বন্ধনকে ‘মুহাজির ও আনসারগণের ভাতৃত্ব বন্ধন’ নামেও অভিহিত করা হয় । আর এই ভাতৃত্বের উদ্দেশ্য ছিলো মূর্খ যুগের বংশীয় সম্পর্ক ছিন্নকরে আত্মীয়তা বা অনাত্মীয়তার সম্পর্ক যা কিছু হবে সবই হবে ইসলামের জন্য । এরপর থেকে মানুষে মানুষে বংশ, বর্ণ ও দেশের সম্পর্ক মুছে যাবে । উঁচু, নীচু ও মানবত্বের মাপকাঠি হবে কেবলমাত্র তাকওয়ার ভিত্তিতে । -(আর-রাহীকুল মাখতুম)
[মুসলিমদের দুঃখ ও দুর্দশা কখনো স্থায়ী হয় না, বরং তা একজন মুসলিমকে দ্বীনের জন্য মজবুত করে তুলে । আর এর শ্রেষ্ঠ উদাহরণ রাসূলুল্লাহ (সা:) এর জীবদ্দশায় মক্কার অত্যাচার, অবিচার এর পর মদীনার সফলতা । যেখান থেকে মুসলিমরা অর্জন করে নিজেদের মধ্যে ভাতৃত্ববোধ ও নেতৃত্ব দেওয়ার শিক্ষা ।]
● আল্লাহর উপর ভরসা:
হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা:) বলেছেন, বদরের যুদ্ধের দিন আল্লাহর নবী (সা:) দোয়া করতে গিয়ে বললেন, হে আল্লাহ! আমি তোমার ওয়াদা ও প্রতিশ্রুতি পূরণ করার জন্য প্রার্থনা করছি । হে আল্লাহ! তুমি যদি চাও (কাফিররা) আমাদের বিরুদ্ধে জয়লাভ করুক তাহলে তোমার ইবাদাতের লোক আর থাকবে না । এতটুকু কথা বলার পর আবু বকর (রা:) তাঁর হাত ধরে বললেন, যথেষ্ট হয়েছে । তখন রাসূলুল্লাহ উঠলেন এবং এ আয়াত পড়লেন, শত্রুদল অচিরেই পরাস্ত হবে এবং পৃষ্ঠপ্রদর্শন করবে । -(বুখারীঃ ৩৬৬২; আ: প্র:)
হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা:) বলেন, বদরের যুদ্ধের দিন আল্লাহর নবী (সা:) বললেন, এই তো জীবরাঈল । ঘোড়ার মাথায় হাত দিয়ে চেপে ধরে যুদ্ধাস্ত্রে সজ্জিত হয়ে তিনি এসে গেছেন । -(বুখারীঃ ৩৬৯৯; আ: প্র:)
[ব্যক্তিগত প্রয়োজন থেকে শুরু করে শত্রুর মোকাবালাতেও আল্লাহর উপর পূর্ণ আস্থা রাখতে হবে । আর আল্লাহর দ্বীন প্রতিষ্ঠায় আল্লাহর সাহায্য আসবেই । তা আমাদের বুঝে আসুক কিংবা না আসুক ।]
● নেতার প্রতি উপদেশ:
সুলাইমান ইবনু বুরাইদাহ (রা) হতে বর্ণিত; তিনি তার পিতা বুরাইদাহ (রা) হতে বর্ণনা করেছেন, রাসূলুল্লাহ (সা) যখন কোন ছোট বা বড় সৈন্যদলের জন্য কাউকে নেতা নির্বাচন করে দিতেন তখন বিশেষভাবে তাকে আল্লাহকে ভয় করার, মুজাহিদ মুসলিমদের সাথে কল্যাণ করার জন্য উপদেশ দিতেন । তারপর বলতেন, আল্লাহর নামে আল্লাহর পথে যুদ্ধ কর, যে আল্লাহর সাথে কুফরী করেছে তার সাথে যুদ্ধ কর, যুদ্ধ করবে, গণিমতের মালে খিয়ানত করবে না, প্রতারণা করবে না, অঙ্গহানী করবে না, বালকদের হত্যা করবে না, যখন তুমি মুশরিক শত্রুদের সাথে মুকাবিলা করবে তখন তাদেরকে তিনটি বিষয়ে দা’ওয়াত দিবে, তার যে কোন একটি ক্ববুল করে নিলে তুমি তা মেনে নিবে এবং তাদের উপর হাত উঠাবে না ।
(১) তাদেরকে ইসলাম ক্ববুল করার দাওয়াত দিবে । যদি তারা তা ক্ববুল করে তুমি তাদের এ স্বীকৃতি মেনে নিবেে । তারপর তাদেরকে মুহাজিরদের কাছে হিজরত করে আসার জন্য দাওয়াত দিবে, তারা সাধারণ গ্রাম্য মুসলিমদের সমশ্রেণীভুক্ত হয়ে থাকবে আর গণিমত ও ফাই (বিনা যুদ্ধে শত্রুপক্ষের যে মাল হস্তগত হয়) এর মালে তাদের জন্য কোন অংশ হবে না, তবে যদি তারা মুসলিমদের সাথে জিহাদে অংশগ্রহণ করে (মাত্র তখন পাবে) ।
(২) যদি তারা ইসলাম ক্ববুল করতে রাজি না হয় তবে তাদের কাছে জিযইয়া (এক প্রকার ট্যাক্স) দাবি করবে । যদি তারা স্বীকার করে তবে তাদের এ স্বীকৃতি মেনে নিবে (আর তাদের দিকে আক্রমণের হাত বাড়াবে না) । আর যদি তারা জিযইয়া কর দিতে অস্বীকার করে তবে আল্লাহর সাহায্য প্রার্থনা করবে ও তাদের সাথে যুদ্ধ করবে ।
(৩) আর যখন কোন দুর্গবাসীদের অবরোধ করবে তখন যদি তারা আল্লাহ ও তার রাসূলের জিম্মায় আসার কোন প্রস্তাব তোমার কাছে পেশ করে, তবে তুমি তা স্বীকার করবে না । বরং তুমি তোমার নিজের জিম্মায় তাদের নিতে পারবে । কেননা তোমাদের জিম্মা নষ্ট করা অনেক সহজ ব্যাপার, আল্লাহর জিম্মাকে নষ্ট করার চেয়ে ।
আর যদি তারা আল্লহর ফয়সালায় উপনীত হওয়ার প্রস্তাব দেয় তবে তুমি তা করবে না । বরং তুমি নিজের ফয়সালার অধীনে তাদেরকে আশ্রয় দিবে । কেননা তুমি অবগত নও যে, তুমি আল্লাহর ফয়সালা তাদের উপর সঠিকভাবে করতে পারবে কি, পারবে না ।
-(মুসলিমঃ ১৭৩১; তিরমিযীঃ ১৪০৮; আবু দাউদঃ ২৬১২; বুলুগুল মারামঃ ১২৬৯)
[একজন নেতাকে অবশ্যই তার অধিনস্থ সঙ্গীদের সাথে উত্তম ব্যবহার করতে হবে এবং নিজের আদর্শকে রক্ষা করে উপরে উল্লিখিত তিনটি বিষয়ের প্রতি সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে]
● মক্কার সেই দিনটিঃ
অবশেষে (মক্কা বিজয়ের পর) তিনি কা’বা প্রাঙ্গনে পৌঁছে গেলেন । প্রথমে হাজরে আসওয়াদের দিকে অগ্রসর হলেন, সেখানে পৌঁছে সেই কৃষ্ঞ প্রস্তরে চুমু দিলেন, তারপর কাবা গৃহ তাওয়াফ করলেন । কা’বা গৃহে এবং তাঁর আশে পাশে তিন শত ষাটটি ঠাকুরদেবতার মূর্তি দণ্ডায়মান দেখে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর হাতে থাকা ছড়ি দিয়ে তাদের প্রতি ইশারা করে বা কপালে খোঁচা দিয়ে তিনি আবৃত্তি করে চললেন কুরআন মাজীদের এই আয়াত:
“সত্য এসে গেল, মিথ্যা বিনিষ্ট হল, মিথ্যার বিনাশ অবশ্যম্ভাবী ।” – সূরা বনী ইসরাইল: ৮১
অতঃপর মূর্তিগুলো ভূলুণ্ঠিত করেন এবং তাদের পূজারীদের চোখের সম্মুখে আল্লাহর মহত্বের ও তাওহীদের জয় ঘোষণা করলেন ।
অতঃপর নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উপস্থিত মক্কাবাসীদের উদ্দেশ্যে বলেন- আজকের দিনে আমি তোমাদের সেই কথাই বলব, যে কথা বলেছিলেন ইউসুফ (আ:) তার ভ্রাতাগণকে-
“আজকের দিনে তোমাদের বিরুদ্ধে কোন অভিযোগ নেই ।” -(সূরা ইউসুফ: ৯২)
আর এ সাধারণ মার্জনায় কোন শর্ত ছিলো না । আর শর্ত ছিলো না বলেই- আবূ সুফইয়ানের স্ত্রী হিন্দাও ক্ষমা পেয়ে যায় । যে কিনা রাসূলের (সা) চাচা হামযার (রা:) শহীদ হওয়ার পর বুক চিরে কলিজা বের করে চিবিয়েছিলো ।
তবে মাত্র ছয় ব্যক্তি (মতান্তরে ১০ ব্যক্তির) উপর তাদের পূর্বকৃত গুরুতর অপরাধের জন্য মৃত্যুদন্ডের হুকুম জারি করা হয়েছিলো । এ ছয় জনের মধ্যে চার জন পুরুষ এবং দু’জন স্ত্রী । পুরুষরা হচ্ছেন: (১) আব্দুল্লাহ ইবনু খাতাল, (২) মাকীস ইবনু সুবাবা, (৩) আব্দুল্লাহ ইবনু সা’দ এবং (৪) ইকরিমাহ ইবনু আবু জাহল । স্ত্রী লোকদের মধ্যে ছিল ইবনু খাতালের দুই দাসী, যাদের নাম সম্বন্ধে যথেষ্ট মতভেদ পরিলক্ষিত হয় ।
এদের মধ্যে পরবর্তীতে আবদুল্লাহ ইবনু সা’দ এবং ইকরিমাহ ইবনু আবু জাহল কে ক্ষমা করে দেয়া হয় । বাকী যে দু’জনকে ক্ষমা করা হয় নি তারা ছিলো ইচ্ছাকৃত হত্যার দোষে দুষ্ট । – (যাদুল মা’আদ)
[মুসলিমদের বিজয়ের একমাত্র উদ্দেশ্যে হলো তাওহীদ প্রতিষ্ঠা করা । আর তা ব্যক্তিজীবন থেকে শুরু করে রাষ্ট্রীয় জীবন পর্যন্ত বিস্তৃত । অর্থাৎ সৃষ্টি করেছেন যিনি, আইনও চলবে তারই । এছাড়া ইসলাম যে কোন বিষয়েই ক্ষমা করার উৎসাহ দিয়ে থাকে, যদি না সে ইচ্ছাকৃতভাবে কাউকে অন্যায়ভাবে হত্যার মতো বড় পাপ করে থাকে । আর এই ক্ষমা বর্তমান গণতান্ত্রিক আর জাতীয়তাবাদীর মতো সময়ে সময়ে বাতিল করা হয় না ।]
● ইসলামী শাসন ব্যবস্থার নমুনা:
হযরত আবু বকর (রা:)র খেলাফত কাল। মদীনায় বসবাস করতো এক অন্ধ মহিলা। মহিলার আপনজন কেউ নাই। তার উপর সে বৃদ্ধা। তাই তার চলাফেরা, খাওয়া-দাওয়ায় খুব কষ্ট হতো। ইসলামী শাসনে এ রকম একজন মহিলা মানবেতর জীবন- যাপন করবে, তা হয়না। তাই হযরত ওমর (রা:) এই মহিলার তত্ত্বাবধানের দায়িত্ব নিলেন।
হযরত ওমর (রা:) প্রতিদিন যথা সময়ে মহিলাকে খাবার পৌঁছানোসহ যাবতীয় কাজ করতেন। এভাবে কিছু দিন গেল। একদিন হযরত ওমর (রা:) খাবার নিয়ে এলেন। এসেই বললেন-
– বুড়ি মা! আপনার জন্যে খাবার নিয়ে এসেছি।
– কে! কে আবার খাবার নিয়ে এসেছো? আমি তো একটু আগেই খাবার খেলাম।
হযরত ওমর (রা:) ভাবনাই পড়লেন। ব্যাপার কি? আমিইতো প্রতি দিন তাকে খাবার দিই। এখন শুনছি অন্য কেউ খাবার খাইয়ে গেছে। হযরত ওমর (রা:) কিছুই বুঝতে পারলেন না। শুধু এ টুকুই বুঝলেন যে, অন্য কেউ এসে এই মহিলাকে খাবার খাইয়ে যায়।
হযরত ওমর কিছু না বলে চলে গলেন। পরদিন ওমর যথা সময়ে এলেন। সে দিনও কে যেন বুড়িয়ে খাইয়ে গেল। সেদিনও ওমর (রা:) চলে গেলেন। এর পরদিন হযরত ওমর আবারও বুড়ির কাজ করতে এলেন।
বুড়িকে বললেন-
আমি কাজ করতে এসেছি।
বুড়ি বলল-
আমার কাজ তো কে যেন একটু আগেই করে দিয়ে গেল।
এবার হযরত ওমর (রা:) ঠিক করলেন। কে এই লোক। যে প্রতিদিন আমার আগে এসে কাজ করে দিয়ে যায়। তাকে আমার বের করতেই হবে। যেই ভাবা, সেই কাজ।
হযরত ওমর (রা:) একতদিন গোপনে লুকিয়ে থাকলেন। দেখলেন ইসলামী প্রজাতন্ত্রের মহান শাসক আবু বকর (রা:) এসে আজ বুড়ির কাজ করে দিয়ে যাচ্ছে। খেলাফতের কঠিন দায়িত্বও তাকে এই বুড়ির কাজ করা থেকে ফেরাতে পারে নি। -(আমরা সেই সে জাতি)
[ইসলামী শাসনব্যবস্থার অধীনে থাকার সবচেয়ে বড় সুবিধা হলো, শাসক তার অধিনস্থ মানুষদের ব্যাপারে এতটাই সচেতন থাকেন, যা ঐ ব্যক্তি নিজেও নিজের প্রতি এতটা সচেতন নন । তাইতো দেখি বিশাল রাজ্যের শাসক হয়েও সেই অন্ধ মহিলার দায়িত্ব নিতে কোন সংকোচ বোধ করে না । বরং ঐ মহিলাকে সাহায্য করতে নিজেদের মধ্যে প্রতিযোগিতা করে । তাই আজও যদি ইসলামী শাসন ব্যবস্থা কায়েম হয়, তাহলে ফুটপাতের দরিদ্র মানুষগুলোর সাথে শাসকের রাত কাটাতে কোন সংকোচ বোধ করবে না । কারণ ইসলাম এটাই শিখায়- এক মুসলিমের দুঃখে অপর মুসলিমও দুঃখিত হবে ।]
● যদিও এখানে খুবই অল্প বিষয় নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে, তবে চেষ্টা করা হয়েছে মূল বিষয়গুলো তুলে ধরতে । আর উল্লিখিত বিষয়গুলো থেকে অন্তত এতটুকু শিক্ষা নেওয়া উচিত যে, ‘আল্লাহ আমাদের পৃথিবীতে পাঠিয়েছেন কেবল তাঁর ইবাদাত করতে এবং সর্ব বিষয়ে তাঁর এককত্ব ও শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিষ্ঠা করতে’ । তাই রঙিন পতাকার ছায়াতলে অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে আল্লাহর আইনকে উপেক্ষা করে মানুষের তৈরী আইন প্রতিষ্ঠা করার নাম বিজয় নয় বরং ব্যর্থতা । আর এই ব্যর্থতাকে মুছে দেওয়ার মধ্যেই মুসলিমের স্বার্থকতা । ইন শা আল্লাহ্ ।
পরিশেষে উমার ইবনে খাত্তাব রাদিয়াল্লাহু আনহুর একটি কথা দিয়ে শেষ করছি-
“আমরা এমন জাতি যাদের কোন অস্তিত্ব ছিলনা, সম্মান ছিলনা। আল্লাহ আমাদের ইসলামের মাধ্যমে সম্মান দিয়েছেন। আমরা যদি ইসলামকে ছেড়ে অন্য কোন কিছুর মাধ্যমে সম্মান পেতে চাই তাহলে আল্লাহ আমাদের আবার লাঞ্ছিত করবেন।”

Main-link: whatislamsay.wordpress.com

ইস্তিখারার নিয়ম ও সুফল

শুরু করছি আল্লাহর নামে যিনি পরম করুণাময়, অতি দয়ালু। 
Image result for salat prayer

হাদীস: عن جَابِرِ بْنِ عَبْدِ اللَّهِ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُمَا قَالَ كَانَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يُعَلِّمُنَا الِاسْتِخَارَةَ فِي الْأُمُورِ كَمَا يُعَلِّمُنَا السُّورَةَ مِنْ الْقُرْآنِ يَقُولُ إِذَا هَمَّ أَحَدُكُمْ بِالْأَمْرِ فَلْيَرْكَعْ رَكْعَتَيْنِ مِنْ غَيْرِ الْفَرِيضَةِ ثُمَّ لِيَقُلْ اللَّهُمَّ إِنِّي أَسْتَخِيرُكَ بِعِلْمِكَ وَأَسْتَقْدِرُكَ بِقُدْرَتِكَ وَأَسْأَلُكَ مِنْ فَضْلِكَ الْعَظِيمِ فَإِنَّكَ تَقْدِرُ وَلَا أَقْدِرُ وَتَعْلَمُ وَلَا أَعْلَمُ وَأَنْتَ عَلَّامُ الْغُيُوبِ اللَّهُمَّ إِنْ كُنْتَ تَعْلَمُ أَنَّ هَذَا الْأَمْرَ خَيْرٌ لِي فِي دِينِي وَمَعَاشِي وَعَاقِبَةِ أَمْرِي أَوْ قَالَ عَاجِلِ أَمْرِي وَآجِلِهِ فَاقْدُرْهُ لِي وَيَسِّرْهُ لِي ثُمَّ بَارِكْ لِي فِيهِ وَإِنْ كُنْتَ تَعْلَمُ أَنَّ هَذَا الْأَمْرَ شَرٌّ لِي فِي دِينِي وَمَعَاشِي وَعَاقِبَةِ أَمْرِي أَوْ قَالَ فِي عَاجِلِ أَمْرِي وَآجِلِهِ فَاصْرِفْهُ عَنِّي وَاصْرِفْنِي عَنْهُ وَاقْدُرْ لِي الْخَيْرَ حَيْثُ كَانَ ثُمَّ أَرْضِنِي قَالَ وَيُسَمِّي حَاجَتَه (أخرجه البخاري).
অনুবাদ:
জাবির (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন: রাসূল (সাঃ) আমাদেরকে সকল ব্যাপারে ইস্তিখারা শিক্ষা দিতেন যেভাবে তিনি আমাদেরকে কুরআনের সূরা শিক্ষা দিতেন। তিনি বলেছেন: তোমাদের কেউ যখন কোন কিছু নিয়ে চিন্তা করে তখন যেন সে ফরয ভিন্ন (অর্থাৎ নফল) দুই রাকাত সালাত আদায় করে অতপরঃ বলে: “হে আল্লাহ্‌! আমি আপনার ইলম অনুসারে আপনার নিকট কল্যাণ কামনা করি। আমি আপনার নির্ধারণের আপনার তাকদির কামনা করি এবং আপনার অপার অনুগ্রহ থেকে (কিছু অনুগ্রহ) কামনা করি। নিশ্চয় আপনিই (ভাগ্য) নির্ধারন করেন, আমি নির্ধারন করিনা। আর আপনি জানেন, আমি জানিনা। হে আল্লাহ্‌! যদি আপনার জ্ঞানে থাকে যে, এই ব্যপারটি আমার দ্বীন, জীবন যাপন, এবং আখিরাতের জন্য কল্যাণকর  অথবা তিনি বলেছেন আমার দুনিয়া ও আখিরাতের জন্য কল্যাণকর, তাহলে আমার জন্য ইহা নির্ধারন করুন। এবং আমার জন্য তা সহজ করে দিন। অতপরঃ এর মধ্যে আমার জন্য বরকত দান করুন। আর যদি আপনার জ্ঞানে থাকে যে এই ব্যাপারটি আমার দ্বীন, আমার জীবন যাপন ও আখিরাতের জন্য অকল্যাণকর অথবা তিনি বলেছেন: আমার পার্থিব জগত ও পরকালের জন্য অকল্যাণকর তাহলে আমাকে এর থেকে দূরে রাখেন এবং ইহাকে আমার থেকে দূরে রাখেন এবং আমার জন্য কল্যাণ নির্ধারন করুন যেখানেই তা নিহিত রয়েছে। অতপরঃ এর দ্বারাই আমাকে সন্তুষ্ট রাখুন”। এবং সে তার প্রয়োজনটি (দোয়ায়) উল্লেখ করবে।

ইস্তিখারার গুরুত্ব ও সুফল
কয়েকটি হাদীস
  •  সা’আদ বিন আবু ওয়াক্কাস (রাঃ) থেকে বর্নিত, রাসূল (সাঃ) বলেন: বনী আদম তার রবের কাছে ইস্তিখারা (কল্যাণ প্রার্থনা) করাই তার সৌভাগ্যের বিষয়। বনী আদমের আরো সৌভাগ্য হচ্ছে আল্লাহ্‌ তাআলা তার জন্য যা নির্ধারন করেন তাতে সন্তুষ্টি থাকার মাধ্যমে। আর বনী আদমের দূর্ভাগ্য হচ্ছে আল্লাহ্‌র নিকট ইস্তিখারা বন্ধ করে দেয়া এবং বনী আদমের আরো দূর্ভাগ্য হচ্ছে আল্লাহ্‌ তাআলা যা নির্ধারন করেছেন তাতে অসন্তুষ্ট হওয়া। [মুসনাদে আহমাদ, হাকেম-ইসনাদ সহীহ, তিরমিযী-গরীব]।
  • রাসূল (সাঃ) যখনি কিছু চাইতেন তখনি বলতেন: হে আল্লাহ্‌! আমার বিষয়টাকে কল্যাণকর করুন এবং তা বাস্তবায়ন করতে আমাকে ইলহাম (ঐশী ইঙ্গিত) করুন। অতপর (ইতিবাচক ও নেতিবাচক) দুইটি বিষয়ের উত্তমটি আমার জন্য নির্বাচিত করুন।[তিরমিযী]।
  • আনাস (রাঃ) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন: রাসূল (সাঃ) বলেছেন: হে আনাস, তুমি যখন কোন বিষয়ে চিন্তা করবে তখন সে বিষয়ে তোমার রবের কাছে সাতবার ইস্তিখারা কর। অতপর: তোমার অন্তরে যা জাগ্রত হয় তার দিকেই তাকাও। নিশ্চয় এর মধ্যেই কল্যাণ রয়েছে। [ইবনুস্‌সুন্নী-গরীব]।
  •  ইবনে তাইমিয়া (রাঃ) বলেন: যে ব্যক্তি সৃষ্টিকর্তার সাথে ইস্তিখারা করে এবং সৃষ্টির (মানুষের) সাথে পরামর্শ করে তার (প্রাপ্ত) বিষয়ে অটল থাকে সে কখনো লজ্জিত হয়না।
রিফলেকশন:
সুপ্রিয় ভাই ও বোন!
  • আপনি কি কখনও এই হাদীসগুলোর উপর আমল করেছেন?
  • আপনি কি রাসূলুল্লাহর এই মৃত সুন্নাতটি কখনও এক মুহুর্তের জন্য জীবিত করেছেন?
  • কতবার আপনি কোন প্রকার গভীর চিন্তা ভাবনা ছাড়াই বিভিন্ন কাজ করে ব্যর্থ হয়েছেন? লজ্জিত হয়েছেন? নিরাশ হয়েছেন করনীয় কাজ থেকে?
  • কতবার আপনি বিভিন্ন কাজে দোদল্যতা ও সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগেছেন?
  • কত বার আপনি মনের প্রশান্তিকে উপেক্ষা করে বিভিন্ন কাজ করে ব্যর্থ ও লজ্জিত হয়েছেন? এত সব অস্থিরতা আর পেরেশানি কিছুই হতনা যদি আপনি ইস্তিখারার মাধ্যমে আপনার চিন্তিত বিষয়ে আল্লাহর নিকট কল্যাণ কামনা করতেন এবং অকল্যাণ থেকে মুক্তি চাইতেন।
  • কতবার আপনি আপাততঃ দৃষ্টিতে চমৎকার লেগেছে তাই গভীর চিন্তা না করে কৃত কর্মের জন্য আপসোস করেছেন আর বলেছেন হায়! যদি এমনটা না করতাম তাহলে এরকম হতনা!
  • কতবার আপনি আপাততঃ দৃষ্টিতে অশোভনীয় লাগার কারণে ভাল সিদ্ধান্ত নিতে পারেননি অথচ তা ছিল আল্লাহ্‌র কাছে কল্যাণকর? এবং আপসোস করেছেন আর বলেছেন হায় যদি এমনটা করতাম তাহলে কতনা ভালো হত!
  • বর্তমানে হয়ত কোন কিছু বাহ্যিক দৃষ্টিতে আপনার কাছে ভাল মানাচ্ছেনা কিন্তু সেটি যে আপনার জন্য কল্যানকর ইস্তিখারা করে প্রশান্তি সহকারে তাতে অগ্রসর হতে পারেন।
  • হয়ত কোন কিছুকে আপনি সুন্দর হিসেবে দেখছেন কিন্তু ইস্তিখারা করে সেটি থেকে সরিয়ে পড়তে পারেন।
  • কোন বিষয়ে আপনার আগেই ঝোঁক থাকলে আসলেই সেটি পজেটিভ ও কল্যাণকর কিনা তা নিশ্চিত হতে ইস্তিখারা করবেন।
  • আপনি হঠাৎ অনাকাংখিত কিছু সিদ্ধান্তের মুখোমুখি হলে এই সে ক্ষেত্রে আপানার ইতিবাচক কিংবা নেতিবাচক সাড়াকে নিশ্চিত করতে ইস্তিখারা করতে পারেন।
কোন বিষয়ে ইস্তিখারা করবেন:
রাসূল (সাঃ) সকল বিষয়েই ইস্তিখারা করতে উদ্ভুদ্ধ করেছেন। কিন্তু অলসতা ও গুরুত্ব না দেয়া ইত্যাদি মানবীয় কারণে ইস্তিখারা করা অনেকের পক্ষেই সম্ভব হয়ে উঠেনা। তাই অন্ততঃ নিজের জীবনের বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলোতে ইস্তিখারা করা প্রয়োজন। তাহলে জীবনের কিছু টার্নিং পয়েন্টে দোদল্যতা, সিদ্ধান্তহীনতা থেকে মুক্তি পাওয়া যাবে এবং এই সকল ক্ষেত্রে যেই সিদ্ধান্ত কল্যাণকর সেই সিদ্ধান্ত নিতে আল্লাহ্‌ তাআলা সাহায্য করবেন। এমন গুরুত্ব বিষয়গুলো যেমন আপনার বিদেশ যাওয়া, নিদিষ্ট কোন চাকুরীতে যোগদান, কারো সাথে ব্যবসা, কারো সাথে আপনার বিবাহ, কাউকে কোন পরামর্শ দেয়া, কোন বিষয়ে সিদ্ধান্ত ইত্যাদি।

ইস্তিখারার সুফল:
  • ব্যক্তিগত বিভিন্ন বিষয়ে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে কার্যকরী সহায়ক।
  • যে কোন সিদ্ধান্তে দোদল্যতা ও সিদ্ধান্তহীনতা থেকে মুক্তি।
  • অনেক গুরুত্বপূর্ণ ও জটিল কাজেও টেনশন ফ্রি ও মানসিক প্রশান্তি।
  • আল্লাহ্‌র উপর ঈমান ও তাওয়াক্কুল (ভরসা) বৃদ্ধি।
  • দুনিয়াবী কাজে ব্যর্থতার লজ্জা থেকে মুক্তি।
  • আল্লাহ্‌র কাছে বেশী বেশী চাওয়ার মানসিকতা তৈরি।
  • আল্লাহ্‌র সাথে ব্যক্তির গোপন ও সরাসরি একটি সম্পর্ক তৈরি হয়।
  • দুনিয়া ও আখিরাতের সফলতা।
ইস্তিখারা কারা করবেন?
  • প্রত্যেক ব্যক্তি তার নিজের প্রয়োজনে সে নিজেই ইস্তিখারা করবে।
  • ব্যক্তির সিদ্ধান্তের সাথে পরিবারের সদস্য, অভিভাবক, আত্নীয় স্বজন এধরণের যারা সম্পৃক্ত তারাও সিদ্ধান্ত নেয়ার ব্যপারে ইস্তিখারা করতে পারেন। কারণ যারা সিদ্ধান্ত নিবেন তিনি যেহেতু তাদের একজন তাই তার সিদ্ধান্ত দেয়ার ব্যপারেও তিনি ইস্তিখারা করবেন।
  • যারা কাছে মানুষ কোন ব্যপারে পরামর্শ চান তারাও সঠিক পরামর্শ দেয়ার জন্য ইস্তিখারা করতে পারেন।
ইস্তিখারা কিভাবে করবেন?

রাতে ঠিক শোয়ার আগে:
১. অযু করে দুই রাকাত নফল নামাজ পড়বেন। এটি স্বাভাবিক নফল নামাজের মতই। এতে বিশেষ কোন নিয়তের প্রয়োজন নেই। তবে সালাত কেন পড়ছেন তা আপনার অন্তরে জাগ্রত থাকাই যথেষ্ট।
২. নামাজের পর ইস্তিখারার দোয়াটি পড়বেন। (উল্লেখ্য যে, হাদীসে দুনিয়া ও আখিরাত বুঝাতে দুই ধরণের শব্দগুচ্ছ বর্ণিত হয়েছে। কিন্তু আপনাকে দোয়াতে একভাবেই বলতে হবে। শব্দগুচ্ছ দুটির প্রথমটি উল্লেখ করলাম। দ্বিতীয় শব্দগুচ্ছটি সহজ হওয়া সত্ত্বেও মুছে দিলাম। কারণ এটির উচ্চারণে আপনাদের ভুল হওয়ার সম্ভাবনা বেশী)।
দোয়ার পূর্ণাঙ্গ রূপ:
اللَّهُمَّ إِنِّي أَسْتَخِيرُكَ بِعِلْمِكَ وَأَسْتَقْدِرُكَ بِقُدْرَتِكَ وَأَسْأَلُكَ مِنْ فَضْلِكَ الْعَظِيمِ فَإِنَّكَ تَقْدِرُ وَلَا أَقْدِرُ وَتَعْلَمُ وَلَا أَعْلَمُ وَأَنْتَ عَلَّامُ الْغُيُوبِ اللَّهُمَّ إِنْ كُنْتَ تَعْلَمُ أَنَّ هَذَا الْأَمْرَ خَيْرٌ لِي فِي دِينِي وَمَعَاشِي وَعَاقِبَةِ أَمْرِي فَاقْدُرْهُ لِي وَيَسِّرْهُ لِي ثُمَّ بَارِكْ لِي فِيهِ وَإِنْ كُنْتَ تَعْلَمُ أَنَّ هَذَا الْأَمْرَ شَرٌّ لِي فِي دِينِي وَمَعَاشِي وَعَاقِبَةِ أَمْرِي فَاصْرِفْهُ عَنِّي وَاصْرِفْنِي عَنْهُ وَاقْدُرْ لِي الْخَيْرَ حَيْثُ كَانَ ثُمَّ أَرْضِنِي
দোয়ার অর্থ:
“হে আল্লাহ্‌! আমি আপনার ইলম অনুসারে আপনার নিকট কল্যাণ কামনা করি। আমি আপনার নির্ধারণের আপনার তাকদির কামনা করি এবং আপনার অপার অনুগ্রহ থেকে (কিছু অনুগ্রহ) কামনা করি। নিশ্চয় আপনিই (ভাগ্য) নির্ধারন করেন, আমি নির্ধারন করিনা। আর আপনি জানেন, আমি জানিনা। হে আল্লাহ্‌! যদি আপনার জ্ঞানে থাকে যে, এই ব্যপারটি আমার দ্বীন, জীবন যাপন, এবং আখিরাতের জন্য কল্যাণকর, তাহলে আমার জন্য ইহা নির্ধারন করুন এবং আমার জন্য তা সহজ করে দিন। অতপরঃ এর মধ্যে আমার জন্য বরকত দান করুন। আর যদি আপনার জ্ঞানে থাকে যে এই ব্যাপারটি আমার দ্বীন, আমার জীবন যাপন ও আখিরাতের জন্য অকল্যাণকর, তাহলে আমাকে এর থেকে দূরে রাখেন এবং ইহাকে আমার থেকে দূরে রাখেন। আর আমার জন্য কল্যাণ নির্ধারন করুন যেখানেই তা নিহিত রয়েছে। অতপরঃ এর দ্বারাই আমাকে সন্তুষ্ট রাখুন”।
৩. দোয়ার শেষে আল্লাহ্‌কে আপনার খুব নিকটে মনে করে তাঁর কাছে আপনার নির্দিষ্ট প্রয়োজনের কথা অনুনয় বিনয় করে বলুন।  দোয়ার সময়ের এটা আন্তরিকভাবে বিশ্বাস রাখুন এবং মনে মনে বলুন আমি আল্লাহ্‌র কাছে যা চাচ্ছি এর রেজাল্ট অবশ্যই তিনি আমাকে দিবেন এবং প্রাপ্ত নির্দেশনাতে আমি সন্তুষ্ট থাকব এবং সে অনুযায়ী কাজ করা শুরু করব। ইনশা আল্লাহ্‌।
৪. এর পর অন্য কোন কিছু না করে এবং যথা সম্ভব কোন কথা না বলে ঘুমের দোয়া পড়ে শুয়ে পড়েন।
(লক্ষনীয়: আপনি যদি আরবী পারেন তাহলে أَنَّ هَذَا الْأَمْرَ  এর স্থানে আপনার আপনার বিষয়টি উল্লেখ করুন। অন্যথায় দোয়াটি পড়ে এর পর আপনার মনের বিষয়টা আল্লাহ্‌র কাছে বলেন এবং এ ব্যপারে কল্যাণকর হলে ইতিবাচক এবং অকল্যাণকর হলে নেতিবাচক নির্দেশনা পেতে ও সে হিসেবে সিদ্ধান্ত নিতে তাঁর সাহায্য কামনা করুন।

408657_10150467809812096_187588732095_9181115_1466138514_n

ইস্তিখারার রেজাল্ট কিভাবে বুঝবেন?
এটি একটি কমন ও গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। রাসুল (সাঃ) আনাস (রাঃ) কে বলেছেন: সাত বার অর্থাৎ পর পর সাতদিন ইস্তিখারা করে মনের গতি ও ঝোঁক যে দিকে যায় তার সিদ্ধান্ত নিতে। কারণ অনেক সময় সরাসরি কোন নির্দেশনা পাওয়া যায়না। তাই না জানার কারণে কনফিউশন থেকে যায়। তাই বিষয়টিকে আরো পরিষ্কার করতে এবং আরো কার্যকর হিসেবে গ্রহণ করতে কিছু টিপস উল্লেখ করলাম। যারা বিভিন্ন বিষয়ে নিয়মিত ইস্তিখারা করে সুফল ভোগ করেছেন তাদের সাথে একান্তে আলাপে যা জানা গেল তা পর্যায়ক্রমে উল্লেখ করলাম:
  • আপনি যে বিষয়ে ভাবছেন আপনি স্বপ্নে হুবহু সে বিষয়ের সিদ্ধান্তের বাস্তবায়ন কিংবা তা বর্জনমূলক কাজ দেখতে পাবেন এবং এটি সরাসরি আপনার সিদ্ধান্তেই। (এটি হচ্ছে ইস্তিখারার সর্বোচ্চ রেজাল্ট)।
  • অথবা আপনি যা ভাবছেন সে বিষয়ে স্বপ্নে আপনার পরিবারের সদস্যদের কিছু ইতিবাচক কিংবা নেতিবাচক কাজ দেখতে পাবেন।
  • অথবা স্বপ্নে কিছু দেখবেননা কিন্তু আপনার মন যত দিন যায় তত বিষয়টির দিকে ঝোঁকতে থাকে কিংবা তার প্রতি অনীহা সৃষ্টি হতে থাকে।
  • অথবা এ ব্যপারে আপনার মন স্বাভাবিক এবং নেতিবাচক কিছু আসছেনা। তাহলেও সিদ্ধান্ত নিতে পারেন।
  • কেউ প্রথম রাতেই রেজাল্ট পেয়ে যান এবং পরে আরও নিশ্চিত হওয়ার জন্য অপেক্ষা করেন। আবার কারো বিলম্বও হয়ে থাকে।
  • আল্লাহ্‌র সাথে আপনার সম্পর্কের উপর ভিত্তি করে আপনি আরও উচ্চ মানের রেজাল্ট ও পেতে পারেন।
ইস্তিখারার আদব
  • আল্লাহ্‌র প্রতি দৃঢ় বিশ্বাস ও ভরসা রেখে ইস্তিখারা করতে হবে।
  • পর পর ন্যুনতম সাত দিন ইস্তিখারা করতে হবে।
  • ইস্তিখারার রেজাল্টের জন্য ধৈয্য সহকারে অপেক্ষা করতে হবে। আল্লাহ্‌ আপনাকে সহযোগিতা করবেন এটা মনে রাখলে আরো সহজ হবে।
  • ইস্তিখারা করার সময় আপনার বিষয়ে আপনাকে নিউট্রেল হতে হবে এই অর্থে যে আপনি যা রেজাল্ট পাবেন সে অনুযায়ী কাজ করার মানসিকতা রাখেন এবং এর মধ্যেই কল্যাণ মনে করেন।
  • ইস্তিখারার রেজাল্ট পেতে বিলম্ব হলে রেজাল্ট পাবেননা এমনটা ভেবে নিরাশ হওয়া যাবেনা।
  • ইস্তিখারার রেজাল্ট পেলে বিশেষ ব্যক্তি কিংবা বিশেষ প্রয়োজন ছাড়া অন্যের কাছে বলা ঠিক নয়। কারণ এর মাধ্যমে আল্লাহ্‌র উপর আপনার তাওয়াক্কুল বাড়ছে এবং ধীরে ধীরে আল্লাহ্‌র সাথে আপনার সম্পর্ক নিবিড় হচ্ছে। আর তাই এমন গোপন বিষয়টা অহেতুক ফাঁস করলে আপনার ইবাদতের মান কমে যাবে এবং নিজের ব্যপারে উচ্চ ধারণা হেতু অহংকার প্রকাশের সম্বাবনা আছে। তাছাড়া এটি আপনার কাজের জন্য দৃঢ় একটি সমর্থক এবং আপনার মনোবলকে দৃঢ় করতে সহকারী। কিন্তু অন্য মানুষের জন্য এটি অকাট্য কিছু নয়। তবে তাদের কাছেই বলবেন যারা আপনাকে জানেন এবং বিষয়টিকে গুরুত্ব দিয়ে আপনাকে আপনার উদ্দৃষ্ট কাজে সহযোগিতা করতে পারেন।
  • নিদিষ্ট সময়ের মধ্যে যদি রেজাল্ট না পাওয়া যায় তাহলে আল্লাহ্‌ আপনাকে দিতে পারেন এই ধারণাকে আরো প্রবল করে কিছু দিন পর একই নিয়মে আবার চেষ্টা করুন। ইনশা আল্লাহ্‌ আপনি নিরাশ হবেননা।
রিফলেকশন:
  • আসলে ইস্তিখারার বিষয়টা সম্পূর্ণভাবে আল্লাহ্‌র সাথে ব্যক্তির সম্পর্কের উপর ভিত্তি করেই হয়ে থাকে। বিষয়টি আল্লাহ্‌র সাথে একান্ত আপনার নিজের। তাই পূর্ণ স্কেলে পরিমাপ আপনিই করতে পারবেন। তবে আল্লাহ্‌র সাথে আপনার বর্তমান সম্পর্ক বেশী ভালো নয় এটা ভেবে ইস্তিখারা থেকে দূরে থাকলে আপনি অপসিদ্ধান্তে ভোগবেন। তাই ইস্তিখারার মাধ্যমেই আল্লাহ্‌র সাথে আপনার সম্পর্ক সৃষ্টি করুন এবং পরিমাপ করুন।
  • আপনার ঈমান, বর্তমান তাওয়াক্কুল এবং আল্লাহ্‌র সাথে সম্পর্কের ভিত্তিতে খুব কম সময়ে খুব স্পষ্ট রেজাল্ট কিংবা কিছু বিলম্বে তুলনামূলক কম স্পষ্ট রেজাল্ট পাবেন। এজন্য প্রচেষ্টাকে অব্যাহত রাখতে হবে। এতেই আপনার কল্যান নিহিত।
  • আপনি যদি একবার ইস্তিখারা রেজাল্ট পান তাহলেই আপনি এর স্বাদ আস্বাদন করবেন এবং এর পর যে কোন গুরুত্বপূর্ণ কাজেই ইস্তিখারা করতে আপনার মন চাইবে।
  • ইস্তিখারার মাধ্যমে আল্লাহ্‌র সাথে বান্দার সম্পর্ক নিবিড় হয় এবং ঈমান ও তাওয়াক্কুল বেড়ে যায়। আল্লাহ্‌ তা’আলা বলেছেন: “মুমিন ব্যক্তিদের আল্লাহর উপর তাওয়াক্কুল করা উচিৎ”।[১৪:১২] তিনি আরো বলেছেন: যে ব্যক্তি আল্লাহ্‌র উপর তাওয়াক্কুল করে তিনি তার জন্য যথেষ্ট।[৬৫:৩]
  • এই ইস্তিখারার সুফল একে বারেই নিশ্চিত। শুধু গ্যারান্টির জন্য প্রয়োজন আপনার প্র্যাকটিস।
Image result for salat prayer

আপনার সিদ্ধান্ত:
আসুন! আমরা মহান আল্লাহ্‌র কাছে আমাদের প্রয়োজন মেটাতে একটু ধরনা দেই। আমাদের নিজেদের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে আল্লাহ্‌র কাছে ইস্তিখারা করতে শিখি এবং ইস্তিখারার মাধ্যমে জীবনের গুরুত্বপূর্ণ ও টার্নিং পয়েন্টগুলোতে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করি। আল্লাহ্‌ রাব্বুল আলামীনের গচ্ছিত কল্যাণ হাসিল করতে উদ্যত হই। দু’একটি ইস্তিখারার সুফল পেয়ে এর নিয়মিত অভ্যাস গড়ে তুলি। এর মধ্যেই মহান আল্লাহ্‌ তা’আলা আমাদের জন্য সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের উপায় ও কল্যাণ নির্ধারন করে রেখেছেন। আল্লাহ্‌ তা’আলা আমাদেরকে ইস্তিখারা করার জন্য মানসিকতা ও তাওফীক দান করুন। আমীন!!

লেখকঃ আবু তালিব মোহাম্মাদ মোনাওয়ার।

Main-link: https://whatislamsay.wordpress.com 

Friday, April 10, 2015

হাদিসের গল্পঃ লোক দেখানো আমলের ভয়াবহ পরিণতি


রহমান রহীম আল্লাহ্‌ তায়ালার নামে-



Destruction











আবু হুরায়রা (রা:) হতে বর্ণিত তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন, ‘ক্বিয়ামতের দিন সর্বপ্রথম যে ব্যক্তির বিচার করা হবে, সে হবে একজন (ধর্মযুদ্ধে শাহাদাত বরণকারী) শহীদ। তাকে আল্লাহ্‌র নিকট উপস্থিত করা হবে। অতঃপর আল্লাহ্‌ পাক তাকে (দুনিয়াতে প্রদত্ত) নেয়ামতসমূহের কথা স্মরণ করিয়ে দিবেন। আর সেও তা স্মরণ করবে। এরপর আল্লাহ্‌ তাআলা তাকে জিজ্ঞেস করবেন, দুনিয়াতে তুমি কি আমল করেছ? উত্তরে সে বলবে, আমি তোমার সন্তুষ্টির জন্য (কাফেরদের সাথে) লড়াই করেছি। এমনকি শেষ পর্যন্ত শহীদ হয়েছি। তখন আল্লাহ্‌ বলবেন, তুমি মিথ্যা বলছ, বরং তোমাকে যেন বীর-বাহাদুর বলা হয়, সেজন্য তুমি লড়াই করেছ। আর (তোমার অভিপ্রায়  অনুযায়ী)  তোমাকে  দুনিয়াতে তা  বলাও  হয়েছে। অতঃপর তার ব্যাপারে আদেশ দেওয়া হবে। তখন তাকে উপুড় করে টেনে-হিঁচড়ে জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে।
অতঃপর সে ব্যক্তিকে বিচারের জন্য উপস্থিত করা হবে, যে নিজে দ্বীনী ইলম শিক্ষা করেছে এবং অপরকে শিক্ষা দিয়েছে। আর পবিত্র কুরআন অধ্যয়ন করেছে (এবং অপরকে শিক্ষা দিয়েছে)। তাকে আল্লাহ্‌ পাকের দরবারে হাযির করা হবে। অতঃপর তিনি তাকে নেয়ামতসমূহের কথা স্মরণ করিয়ে দিবেন এবং সেও তা স্মরণ করবে। অতঃপর আল্লাহ্‌ তাআলা তাকে জিজ্ঞেস করবেন, এই সমস্ত নেয়ামতের শুকরিয়া জ্ঞাপনের জন্য তুমি কি আমল করেছ? উত্তরে সে বলবে, আমি স্বয়ং দ্বীনী ইলম শিক্ষা করেছি এবং অপরকে  শিক্ষা  দিয়েছি এবং তোমার সন্তুষ্টির নিমিত্তে কুরআন তেলাওয়াত করেছি। তখন আল্লাহ্‌ বলবেন, তুমি মিথ্যা বলছ। আমার সন্তুষ্টির জন্য নয়, বরং তুমি এজন্য ইলম্ শিক্ষা করেছ, যেন তোমাকে ‘বিদ্বান’বলা হয় এবং এজন্য কুরআন অধ্যয়ন করেছ, যাতে তোমাকে‘ক্বারি’ বলা হয়। আর (তোমার অভিপ্রায় অনুযায়ী ) তোমাকে বিদ্বান ও ক্বারীও বলা হয়েছে। অতঃপর (ফেরেশতাদেরকে) তার সম্পর্কে নির্দেশ দেওয়া হবে। সুতরাং তাকে উপুড় করে টানতে টানতে জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে।
অতঃপর এমন এক ব্যক্তিকে বিচারের জন্য আল্লাহ্‌র দরবারে উপস্থিত করা হবে, যাকে আল্লাহ্ তাআলা বিপুল ধন-সম্পদ দান করে বিত্তবান করেছিলেন। তাকে আল্লাহ্‌  তাআলা প্রথমে প্রদত্ত নেয়ামতসমূহের কথা স্মরণ করিয়ে দিবেন। আর সে তখন সমস্ত নেয়ামতের কথা অকপটে স্বীকার করবে। অতঃপর তিনি তাকে জিজ্ঞেস করবেন, এই সমস্ত নেয়ামতের  শুকরিয়ায় তুমি কি আমল করেছ? উত্তরে সে বলবে, যে সমস্ত ক্ষেত্রে ধন- সম্পদ ব্যয় করলে তুমি সন্তুষ্ট হবে, তোমার সন্তুষ্টির জন্য সেসব খাতের একটি পথেও ব্যয় করতে ছাড়িনি। আল্লাহ্‌  তাআলা বলবেন, তুমি মিথ্যা বলছ। আমার সন্তুষ্টির জন্য নয়; বরং তুমি এই উদ্দেশ্যে দান করেছিলে, যাতে তোমাকে বলা হয় যে, সে একজন ‘দানবীর’। সুতরাং (তোমার অভিপ্রায় অনুসারে দুনিয়াতে) তোমাকে ‘দানবীর’বলা হয়েছে। অতঃপর (ফেরেশতাদেরকে) তার সম্পর্কে নির্দেশ দেওয়া হবে। নির্দেশ মোতাবেক তাকে উপুড় করে টানতে টানতে জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে ।  

[মুসলিম হা/১৯০৫  ‘নেতৃত্ব’অধ্যায়,  অনুচেছদ-৪৩;  মিশকাত-আলবানী  হা/২০৫,  ‘ইলম’অধ্যায় ]

শিক্ষা:

লোক দেখানো আমলের পরিণতি অত্যন্ত ভয়াবহ। কাজেই সর্বদা আমাদের নিয়তকে পরিশুদ্ধ রাখতে হবে এবং প্রতিটি কাজ একমাত্র আল্লাহ্‌ পাকের সন্তুষ্টির জন্যই করতে হবে।

হাদিসের গল্পঃ ঈমানদার যুবক ও আছহাবুল উখদূদের কাহিনী


রহমান রহীম আল্লাহ্‌ তায়ালার নামে-

alone-boy-ocean-sunrise-favim-com-112915 
বহুকাল পূর্বে একজন রাজা ছিলেন। সেই রাজার ছিল একজন যাদকুর। ঐ যাদুকর বৃদ্ধ হ’লে একদিন সে রাজাকে বলল,‘আমি তো বৃদ্ধ হয়ে গেছি। সুতরাং আমার নিকট একটি ছেলে পাঠান, যাকে আমি যাদুবিদ্যা শিক্ষা দিব’। বাদশাহ তার নিকট একটি বালককে পাঠিয়ে দিলেন। তিনি তাকে যাদুবিদ্যা শিক্ষা দিতে লাগলেন। বালকটি যাদুকরের নিকট যে পথ দিয়ে যাতায়াত করত, সে পথে ছিল এক সন্ন্যাসীর আস্তানা। বালকটি তার নিকট বসল এবং তার কথা শুনে মুগ্ধ  হ’ল। বালকটি যাদুকরের নিকট যাওয়ার সময় ঐ সন্ন্যাসীর নিকট বসে তাঁর কথা শুনত। ফলে যাদুকরের নিকট পৌছাতে বালকটির দেরী হ’ত বলে যাদুকর তাকে প্রহার করত। বালকটি সন্ন্যাসীর নিকট এ কথা জানালে তিনি বালককে শিখিয়ে দেন যে,তুমি যদি যাদুকর কে ভয় কর তাহ’লে বলবে, বাড়ীর লোকজন আমাকে পাঠাতে বিলম্ব  করেছে  এবং  বাড়ীর  লোকজনকে  ভয়  পেলে  বলবে, যাদুকরই আমাকে ছুটি দিতে বিলম্ব করেছে।
 বালকটি এভাবে যাতায়াত করতে থাকে। একদিন পথে সে দেখল,একটি বৃহদাকার প্রাণী মানুষের চলাচলের পথ রোধ করে বসে আছে। বালকটি ভাবল, আজ পরীক্ষা করে দেখব যে, যাদুকর শ্রেষ্ঠ, না সন্ন্যাসী শ্রেষ্ঠ? অতঃপর সে একটি প্রস্তর খন্ড নিয়ে বলল, ‘হে আল্লাহ্‌! যাদুকরের কার্যকলাপ অপেক্ষা সন্ন্যাসীর কার্যকলাপ যদি তোমার নিকট অধিকতর প্রিয় হয়, তবে এই প্রাণীটিকে এই প্রস্তরাঘাতে মেরে ফেল। যেন লোকজন যাতায়াত করতে পারে’। এই বলে প্রাণীটিকে লক্ষ্য করে সে প্রস্তরখন্ডটি ছুঁড়ে মারল। প্রাণীটি ঐ প্রস্তাঘাতে মারা গেল এবং লোক চলাচল শুরু হল।
 এরপর বালকটি সন্ন্যাসীর নিকট গিয়ে তাকে ঘটনাটি জানালে তিনি তাকে বললেন, বৎস! তুমি এখনই আমার চেয়ে শ্রেষ্ঠ হয়ে উঠেছ। তোমার প্রকৃত স্বরূপ আমি বুঝতে পারছি। শীঘ্রই তোমাকে পরীক্ষার সম্মুখীন হতে হবে। যদি তুমি পরীক্ষার সম্মুখীন হও তাহলে যেন আমার কথা প্রকাশ করে দিও না। বালকটির দোআয় জন্মান্ধ ব্যক্তি চক্ষুষ্মান হতে লাগল, কুষ্ঠ ব্যাধিগ্রস্ত ব্যক্তি নিরাময় হতে লাগল এবং লোকজন অন্যান্য রোগ হতেও আরোগ্য লাভ করতে লাগল।
 এদিকে রাজার একজন সহচর অন্ধ হয়েছিল। সে বহু উপঢৌকন সহ বালকটির নিকট গিয়ে বলল, তুমি যদি আমাকে চক্ষুষ্মান করে দাও, তাহলে এ সবই তোমার।  বালকটি বলল, আমিতো কাউকে আরোগ্য করতে পারি না । বরং  রোগ ভাল করেন আল্লাহ্‌। অতএব আপনি যদি আল্লাহর প্রতি ঈমান আনেন, তাহলে আমি আপনার রোগ মুক্তির জন্য আল্লাহর  নিকটে  দোআ  করতে  পারি।  তাতে  তিনি  হয়ত  আপনাকে আরোগ্য দান করতে পারেন। ফলে লোকটি আল্লাহর প্রতি ঈমান আনল। আল্লাহ তাকে আরোগ্য দান করলেন।
পূর্বের ন্যায় তিনি রাজার নিকটে গিয়ে বসলে রাজা তাকে জিজ্ঞেস করলেন, কে তোমাকে দৃষ্টিশক্তি ফিরিয়ে দিল? সে বলল, ‘আমার রব’। রাজা বললেন, আমি ছাড়া তোমার রব আছে কি? সে বলল, ‘আমার ও আপনার উভয়ের রব আল্লাহ’। এতে রাজা তাকে ধরে তার উপর নির্যাতন চালাতে থাকে। অবশেষে সে বালকটির নাম প্রকাশ করে দিল। অতঃপর বালকটিকে রাজদরবারে আনা হল। রাজা তাকে বললেন, বৎস!আমি জানতে পারলাম যে, তুমি তোমার যাদুর গুণে জনমান্ধ ও কুষ্ঠোব্যাধিগ্রস্ত লোকদের রোগ নিরাময় করছ এবং অন্যান্য কঠিন রোগও নিরাময় করে চলেছ। বালকটি বলল, আমি কাউকে রোগ মুক্ত করি না। রোগ মুক্ত করেন আল্লাহ। তখন রাজা তাকে পাকড়াও করে তার উপর উৎপীড়ন চালাতে থাকেন। এক পর্যায়ে সে সন্ন্যাসীর কথা প্রকাশ করে দিল। তখন সন্ন্যাসীকে ধরে আনা হ’ল এবং তাঁকে বলা হল, তুমি  তোমার ধর্ম পরিত্যাগ কর। কিন্তু সে অস্বীকৃতি জ্ঞাপন করল। তখন রাজার আদেশক্রমে করাত নিয়ে আসা হলে তিনি তা তার মাথার মাঝখানে বসালেন এবং তাঁর মাথা ও শরীর চিরে দ্বিখন্ডিত করে ফেললেন। তারপর রাজার সহচরকে আনা হল এবং তাকেও তার ধর্ম ত্যাগ  করতে বলা হল। কিন্তু সেও অস্বীকৃতি জানালে তাকেও করাত দিয়ে চিরে দ্বিখন্ডিত করা হল।
 তারপর বালকটিকে হাযির করে তার ধর্ম পরিত্যাগ করতে বলা হল। বালকটিও নিজ ধর্ম পরিত্যাগ করতে অস্বীকার করল। তখন রাজা তাকে তার লোকজনের নিকট দিয়ে বললেন, তোমরা একে অমুক পাহাড়ে নিয়ে যাও এবং তাকে সঙ্গে করে পাহাড়ে আরোহণ করতে থাক। যখন তোমরা পাহাড়ের উচ্চশৃঙ্গে পৌঁছাবে, তখন তাকে তার ধর্ম পরিত্যাগ করতে বলবে। সে যদি অস্বীকার করে, তাহলে তোমরা তাকে সেখান থেকে নীচে ছুড়ে ফেলে দিবে। তারা বালকটিকে নিয়ে পাহাড়ের উপরে উঠলে বালকটি দো‘আ করল, ‘হে আল্লাহ্‌! তোমার যেভাবে  ইচ্ছা হয়, সেভাবে তুমি আমাকে এদের কাছ থেকে রক্ষা কর’। তৎক্ষণাৎ পাহাড়টি কম্পিত হয়ে উঠল এবং তারা নীচে পড়ে মারা গেল। আর বালকটি (সুস্থ দেহে) রাজার নিকট এসে উপস্থিত হল। রাজা তখন তাকে বললেন, ‘তোমার সঙ্গীদের কি  হল’? তখন সে বলল, আল্লাহই  আমাকে  তাদের  হাত  থেকে বাঁচিয়েছেন।
 তারপর রাজা তাকে তার একদল লোকের নিকট সোপর্দ করে আদেশ দিলেন, ‘একে একটি বড় নৌকায় উঠিয়ে  নদীর মাঝখানে নিয়ে যাও। যদি সে নিজ ধর্ম পরিত্যাগ করে, তো ভাল। নচেৎ তাকে নদীতে নিক্ষেপ কর।’ তারা বালকটিকে নিয়ে মাঝ নদীতে পৌঁছালে বালকটি পূর্বের ন্যায় দোআ করল, ‘হে আল্লাহ্‌! তোমার যেভাবে ইচছা হয়, সেভাবে তুমি আমাকে এদের হাত থেকে রক্ষা কর’। এতে নৌকা ভীষণভাবে কাত হয়ে পড়ল। ফলে রাজার লোকজন নদীতে ডুবে মারা গেল। আর বালকটি (সুস্ত দেহে) রাজার নিকটে আসলে রাজা তাকে বললেন, তোমার সঙ্গীদের কি অবস্থা? সে বলল, আল্লাহ্‌ই আমাকে তাদের হাত থেকে রক্ষা করেছেন। এরপর সে রাজাকে বলল, ‘আপনি যতই চেষ্টা করুন না কেন আমাকে কোনভাবেই হত্যা করতে পারবেন না। যতক্ষণ না আমি যা বলব, আপনি তা করবেন। রাজা বললেন, ‘সেটা কি’? বালকটি বলল, ‘আপনি একটি বিসতীর্ণ মাঠে সকল লোককে হাযির করুন এবং সেই মাঠে খেজুরের একটি গুঁড়ি পুঁতে তার উপরিভাগে আমাকে বেঁধে রাখুন। তারপর আমার তূনীর হতে একটি তীর  নিয়ে  ধনুকে  সংযোজিত  করুন। তারপর (বালকটির রব আল্লাহর নামে) বলে আমার দিকে তীরটি নিক্ষেপ করুন। আপনি  যদি  এ  পন্থা অবলম্বন  করেন, তবেই  আমাকে  হত্যা  করতে পারবেন।
 বালকের কথামত এক বিসতীর্ণ মাঠে রাজা সকল লোককে সমবেত করলেন এবং বালকটিকে একটি খেজুর গাছের গুঁড়ির উপরে বাঁধলেন। তারপর রাজা  বালকটির  তূনীর  হতে  একটি  তীর  নিয়ে  ধনুকের  মধ্যভাগে সংযোজিত করলেন। তারপর বলে বালকটির দিকে তীর নিক্ষেপ করলেন। তীরটি বালকের চোখ ও কানের মধ্যভাগে বিদ্ধ হল। বালকটি এক হাতে তীরবিদ্ধ স্থানটি চেপে ধরল। অতঃপর সে মারা গেল।
 এ দৃশ্য দেখে উপস্থিত জনগণ বলে উঠল, ‘আমরা বালকটির রবের প্রতি ঈমান আনলাম।  আমরা বালকটির রবের প্রতি ঈমান আনলাম। তারপর রাজার লোকজন তাঁর নিকট গিয়ে বলল, ‘আপনি যা আশঙ্কা করছিলেন তাই শেষ পর্যন্ত ঘটে গেল। সব লোক বালকটির রবের প্রতি ঈমান আনল’। তখন রাজা রাস্তাগুলির চৌমাথায় প্রকান্ড গর্ত খনন করার নির্দেশ দিলেন। তার কথা মতো গর্ত খনন করে তাতে আগুন প্রজ্জ্বলিত করা হ’ল। তারপর রাজা হুকুম দিলেন, ‘যে ব্যক্তি বালকের ধর্ম পরিত্যাগ করবে না, তাকে ঐ আগুনের মধ্যে নিক্ষেপ করে পুড়িয়ে মার। অথবা তাকে বলবে, তুমি এই আগুনে ঝাঁপ দাও। রাজার লোকেরা তার হুকমু পালন  করতে  লাগল। ইতিমধ্যে  একজন  রমণীকে  তার  শিশুসন্তাসহ উপস্থিত করা হল। রমণীটি আগুনে ঝাঁপ দিতে ইতস্তত করতে থাকলে শিশুটি বলে উঠল, ‘মা ছবর অবলম্বন (করতঃ আগুনে প্রবেশ) করুন।কেননা আপনি হক পথে আছেন’।
পবিত্র কুরআনের সূরা বুরূজে এ ঘটনার দিকে ইঙ্গিত করে বলা হয়েছে,
‘ধবংস হয়েছিল গর্তওয়ালারা- ইন্ধনপূর্ণ যে গর্তে ছিল অগ্নি, যখন তারা তার পাশে উপবিষ্ট ছিল এবং তারা মুমিনদের সাথে যা করছিল তা প্রত্যক্ষ করছিল। তারা তাদেরকে নির্যাতন করেছিল শুধু একারনে যে, তারা বিশ্বাস করতো পরাক্রমশালী ও প্রশংসার্হ আল্লাহে’ (বুরূজ ৪-৮)।
[সহীহ মুসলিম হা/৩০০৫ ‘যুহদ ও রিক্বাক্ব’ অধ্যায়, অনুচেছদ-১৭, শুহাইব বিন সিনান আর-রূমী (রাঃ) হতে বর্ণিত, আহমাদ হা/২৩৯৭৬]।

শিক্ষা :

১.  প্রত্যেকটি আদম সন্তান স্বভাবধর্ম ইসলামের উপর জন্মগ্রহণ করে।
২. মুমিন বান্দা সর্বদা আল্লাহকে স্মরণ করবে ও কায়মনোবাক্যে তাঁর নিকট দো‘আ করবে।
৩. রোগমুক্তির মালিক একমাত্র আল্লাহ্‌; কোন পীর-ফকীর বা সাধু-সন্ন্যাসী নয়।
৪. আল্লাহর পথের নির্ভীক সৈনিকেরা বাতিলের সামনে কখনো মাথা নত করে না।
৫. মুমিন দুনিয়াবী জীবনে পদে পদে পরীক্ষার সম্মুখীন হবে। এর মাধ্যমে আল্লাহ্ তার ঈমানের মযবূতী পরখ করেন।
৬. হক্বের বিজয় অবশ্যম্ভাবী।



হাদিসের গল্পঃ পাহাড়ের গুহায় আঁটকে পড়া তিন যুবক


রহমান রহীম আল্লাহ্‌ তায়ালার নামে-

the_cave_beam_lead_my_way
একবার তিনজন লোক পথ চলছিল, এমন সময় তারা বৃষ্টিতে আক্রান্ত হ’ল। অতঃপর তারা এক পাহাড়ের গুহায় আশ্রয় নিল। হঠাৎ পাহাড় হ’তে এক খন্ড পাথর পড়ে তাদের গুহার মুখ বন্ধ হয়ে গেল। তখন তারা একে অপরকে বলল, নিজেদের কৃত কিছু সৎকাজের কথা চিন্তা করে বের কর, যা আললাহর সন্তুষ্টির জন্য তোমরা করেছ এবং তার মাধ্যমে আললাহর নিকট দো‘আ কর। তাহ’লে হয়ত আল্লাহ্‌ তোমাদের উপর হ’তে পাথরটি সরিয়ে দিবেন।
তাদের একজন বলতে লাগল, হে আল্লাহ্‌! আমার আববা-আম্মা খুব বৃদ্ধ ছিলেন এবং আমার ছোট ছোট সন্তানও ছিল। আমি তাদের ভরণ-পোষণের জন্য পশু পালন করতাম। সন্ধ্যায় যখন আমি বাড়ি ফিরতাম তখন দুধ দোহন করতাম এবং আমার সন্তান্দের  আগে আমার আববা-আম্মাকে পান করাতাম। একদিন আমার ফিরতে দেরী হয় এবং সন্ধ্যা হওয়ার আগে আসতে পারলাম না। এসে দেখি তারা ঘুমিয়ে পড়েছেন। আমি দুধ দোহন করলাম, যেমন প্রতিদিন দোহন করি। তারপর আমি তাঁদের শিয়রে (দুধ নিয়ে) দাঁড়িয়ে রইলাম। তাদেরকে জাগানো আমি পছন্দ করিনি এবং তাদের আগে আমার বাচ্চাদেরকে পান করানোও সঙ্গত মনে করিনি। অথচ বাচ্চাগুলো দুধের জন্য আমার পায়ের কাছে পড়ে কান্নাকাটি করছিল। এভাবে ভোর হয়ে গেল। হে আল্লাহ্‌! আপনি জানেন আমি যদি শুধু আপনার সন্তুষ্টির জন্যই এ কাজটি করে থাকি তবে আপনি আমাদের হ’তে পাথরটা খানিক সরিয়ে দিন, যাতে আমরা আসমানটা দেখতে পাই। তখন আল্লাহ পাথরটাকে একটু সরিয়ে দিলেন এবং তারা আসমান দেখতে পেল।
দ্বিতীয় ব্যক্তি বলল, হে আল্লাহ্‌! আমার এক চাচাতো বোন ছিল। পুরুষরা যেমন মহিলাদেরকে ভালবাসে,আমি   তাকে  তার চেয়েও অধিক ভালবাসতাম। একদিন আমি তার কাছে চেয়ে বসলাম (অর্থাৎ খারাপ কাজ করতে চাইলাম)। কিন্তু তা সে অস্বীকার করল যে পর্যন্ত না আমি তার জন্য একশ’ দিনার নিয়ে আসি। পরে চেষ্টা করে আমি তা যোগাড় করলাম (এবং তার কাছে এলাম)। যখন আমি তার দু’পায়ের মাঝে বসলাম (অর্থাৎ সম্ভোগ করতে তৈরী হলাম) তখন সে বলল, হে আললাহর বান্দা! আল্লাহকে ভয়  কর। অন্যায়ভাবে মোহর (পর্দা) ছিঁড়ে দিয়ো না। (অর্থাৎ আমার সতীত্ব নষ্ট করো না)। তখন আমি দাঁড়িয়ে গেলাম। হে আল্লাহ! আপনি জানেন আমি যদি শুধু আপনার সন্তুষ্টির জন্য এ কাজটি করে থাকি, তবে আপনি আমাদের জন্য পাথরটা সরিয়ে দিন। তখন পাথরটা কিছুটা সরে গেল।
তৃতীয় ব্যক্তি বলল, হে আল্লাহ্‌! আমি এক ‘ফারাক’ চাউলের বিনিময়ে একজন শ্রমিক নিযুক্ত করেছিলাম। যখন সে তার কাজ শেষ করল আমাকে বলল, আমার পাওনা দিয়ে দাও। আমি তাকে তার পাওনা দিতে গেলে সে তা নিল না। আমি তা দিয়ে কৃষি কাজ করতে লাগলাম এবং এর দ্বারা অনেক গরু ও তার রাখাল জমা করলাম। বেশ কিছু দিন পর সে আমার কাছে আসল এবং বলল, আল্লাহকে ভয় কর (আমার মজুরী দাও)। আমি বললাম, এই সব গরু ও রাখাল নিয়ে নাও। সে বলল, আল্লাহকে ভয় কর, আমার সাথে ঠাট্টা কর না। আমি বললাম, আমি তোমার সাথে ঠাট্টা করছি না, ঐগুলো নিয়ে নাও। তখন সে তা নিয়ে গেল। হে আল্লাহ! আপনি জানেন, যদি আমি আপনার সন্তুষ্টি লাভের জন্য এ কাজটি করে থাকি, তবে পাথরের বাকীটুকু সরিয়ে দিন। তখন আল্লাহ পাথরটাকে সরিয়ে দিলেন।
(আব্দুললাহ  ইবনু  ওমর  (রাঃ)  হ’তে  বর্ণিত,  বুখারী  হা/২৩৩৩,  ‘চাষাবাদ’  অধ্যায়, অনুচেছদ-১৩; মুসলিম হা/২৭৪৩, মিশকাত হা/৪৯৩৮)।
শিক্ষা :
১. বান্দা সুখে-দুঃখে সর্বদা আল্লাহকে ডাকবে।
২. বিপদাপদের সময় আল্লাহকে ব্যতীত কোন মৃত ব্যক্তি বা অন্য কাউকে ডাকা শিরকে আকবর বা বড় শিরক।
৩. সৎ আমলকে অসীলা হিসাবে গ্রহণ করতে হবে।
৪. পিতা-মাতার প্রতি সদ্ব্যবহার করতে হবে এবং স্ত্রী ও সন্তানদের উপর তাদেরকে প্রাধান্য দিতে হবে।
৫. শ্রমিককে তার ন্যায্য পাওনা প্রদান করতে হবে।

Tuesday, April 7, 2015

১০টি ইসলাম ধ্বংসকারী বিষয়


FireG

মূলঃ আল্লামা শাইখ আব্দুল আযীয বিন আব্দুল্লাহ্‌ বিন বায (রহঃ) অনুবাদঃ শাইখ আখতারুল আমান বিন আব্দুস সালাম








 
রহমান রহীম আল্লাহ্‌ তায়ালার নামে-
সমস্ত প্রশংসা আল্লাহ তাআলার জন্য নিবেদিত। দরূদ ও সালাম অবতীর্ণ হোক সেই মহান নবীর উপর যার পরে আর কোন নবী নেই। আরো নাযিল হোক তাঁর পরিবার বর্গ, সহচর বৃন্দ এবং তাঁর হেদায়াতের অনুসারীদের উপর।
অত:পর হে মুসলিম ভাই! এ কথা জেনে নিন যে, আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা সকল বান্দার উপর ইসলামে প্রবেশ করা, উহা আঁকড়ে ধরা এবং উহার পরিপন্থী বিষয় থেকে সতর্ক থাকা ফরজ করেছেন। আর নবী মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে সে দিকে আহবান করার জন্যই প্রেরণ করেছেন। আল্লাহ্‌ এই মর্মে ঘোষণা দিয়ে বলেন, যে ব্যক্তি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর অনুসরণ করবে সে হেদায়াত প্রাপ্ত হবে পক্ষান্তরে যে তাঁর থেকে বিমুখ হবে সে পথভ্রষ্ট হবে। তিনি বহু আয়াতে মুরতাদ হওয়ার মাধ্যম, শির্ক ও কুফরীর সকল প্রকার হতে সতর্ক করেছেন।
বিদ্যানগণ মুরতাদের বিধি-বিধান অধ্যায়ে এই মর্মে উল্লেখ করেছেন যে, একজন মুসলমান ব্যক্তির রক্ত ও ধন-সম্পদ হালাল কারী বিভিন্ন ইসলাম বিধ্বংসী কার্য কলাপ সম্পদনের মাধ্যমে মুরতাদ ও ইসলাম হতে বহিস্কার হয়ে যায়।
ইসলাম বিধ্বংসী কাজ হল সর্ব মোট ১০টি যা শাইখুল ইসলাম ইমাম মুহাম্মাদ বিন সুলায়মান আত তামীমী (রহিমাহু্মুল্লাহ) ও অন্যান্য বিদ্বানগণ উল্লেখ করেছেন। আমরা ঐ সকল ইসলাম বিধ্বংসী কাজ গুলো নিন্মে সংক্ষিপ্ত ভাবে কিঞ্চিত ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ সহ আপনার জন্য উল্লেখ করছি। যাতে আপনি উক্ত বিষয়গুলো থেকে সতর্ক থেকে অপরকে সতর্ক করতে পারেন।
ইসলাম বিধ্বংশী কাজ গুলো নিন্মরূপঃ
প্রথমঃ
আল্লাহর ইবাদতে শির্ক করা। আল্লাহ বলেনঃ

إنَّ اللهَ لاَيَغْفِرُ أنْ يُشْرَكَ بِهِ وَيَغْفِرُ ماَ دُوْنَ ذلكَ لِمَنْ يَشاَءُ

“নিশ্চয় আল্লাহ তার সাথে শির্ক করাকে ক্ষমা করেন না। উহা ব্যতিরেকে উহার নিন্ম পর্যায়ের পাপ সবই তিনি যাকে ইচছা ক্ষমা করেন”। [নিসা : ১১৬]
আল্লাহ তাআলা আরও বলেনঃ

إنَّهُ مَنْ يُشْرِكُ بِاللهِ فَقَدْ حَرَّمَ اللهُ عَلَيْهِ الْجَنَّةَ وَمَأْوَاهُ النَّارُ وَمَا لِلظاَّلِمِيْنَ مِنْ أنْصَارِ

“নিশ্চয়ই যে ব্যক্তি শির্ক করবে আল্লাহ তার উপর জান্নাত হারাম করে দিবেন এবং তার বাসস্থান হবে জাহান্নাম, আর এই সমস্ত যালিমদের জন্য কোন সাহায্যকারী থাকবে না”। [সূরা মায়েদাহ্‌ : ৭২]
জ্ঞাতব্যঃ এই শির্কের অন্তর্ভূক্ত হল: মৃতকে আহবান করা, তাদের নিকট ফরিয়াদ করা, তাদের জন্য নযর-নেয়াজ মানা ও পশু যবেহ করা। যেমন কোন ব্যক্তি জ্বিনের জন্য বা কোন কবেরর জন্য যবেহ করল ইত্যাদি।
দ্বিতীয়ঃ
নিজের ও আল্লাহর মধ্যে মধ্যস্থতা সাব্যস্ত করে তাদের উপরেই ভরসা রাখা। এই ধরণের ব্যক্তি সর্ব সম্মতিক্রমে কাফের বলে গণ্য।
তৃতীয়ঃ 
মুশরিককে মুশরিক বা কাফেরকে কাফের না বলা বা তাদের কুফরীতে সন্দেহ পোষণ করা কিংবা তাদের ধর্মকে সঠিক ভাবা।
চতুর্থঃ
এই বিশ্বাস করা যে অন্যের আদর্শ নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের আদর্শের চাইতে অধিক পূর্ণাঙ্গ। কিংবা এই বিশ্বাস করা যে, অন্যের বিধান নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের বিধান অপেক্ষা অধিক উত্তম। (যেমন কেউ কেউ তাগুতের বিধানকে নবীর বিধানের উপর শ্রেষ্ঠত্ব দিযে থাকে) সে ব্যক্তি কাফের বলে গণ্য হবে।
পঞ্চমঃ 
 রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আনিত কোন বস্তুকে ঘৃণার চোখে দেখা। এমতাবস্থায় সে কাফের বলে গণ্য হবে যদিও সে ঐ বস্তুর উপর বাহ্যিক ভাবে আমল করে। আল্লাহ তাআলা বলেনঃ

ذلكَ بِأنَّهُمْ كَرِهُوا ماَ أنْزَل اللهُ فَأحْبَطَ أعْماَلَهُمْ

“ইহা এজন্যই যে, তারা আল্লাহর নাজিলকৃত বিষয়কে ঘৃণা করেছে সুতরাং আল্লাহ তাদের আমল গুলোকে পণ্ড করে দিয়েছেন”। [সূরা মুহাম্মাদ : ৯]
ষষ্ঠঃ
দ্বীনের কোন বিষয় নিয়ে বা তার পুরস্কার কিংবা শাস্তিকে নিয়ে ঠাট্টা-বিদ্রুপ করা। আল্লাহ্‌ তাআলা বলেনঃ

قُلْ أبِاللهِ وآياَتِهِ وَرَسُوْلِهِ كُنْتُمْ تستهزئون . لاَ تَعْتَذِرُوْا قَدْ كَفَرْتُمْ بَعْدَ إيْماَنِكُمْ

“আপনি বলুন (হে রাসূল) তোমরা কি আল্লাহর সাথে, স্বীয় আয়াত সমূহের সাথে এবং রসূলের সাথে ঠাট্টা করছিলে? কোন প্রকার ওজর-আপত্তির অবতারণা কর না। তোমরা ঈমান আনায়নের পর আবার কুফরী করেছ”। [সূরা তাওবাহ্‌ : ৬৫-৬৬]
সপ্তমঃ
যাদু-টোনা করা: যাদুর অন্যতম প্রকার হল তন্ত্র-মন্ত্রের সাহায্যে দুজন মানুষের বন্ধন তৈরী করা বা তাদের মাঝে সম্পর্ক ছিন্ন করা। সুতরাং যে ব্যক্তি যাদু করবে বা তাতে রাজি হবে সে কাফের বলে বিবেচিত হবে। আল্লাহ তাআলার বলেনঃ

(وماَ يُعَلِّماَنِ مِنْ أحَدٍ حَتىَّ يَقُوْلاَ إنَّماَ نَحْنُ فِتْنَةٌ فَلاَ تَكْفُرْ )

“ঐ দুজন (হারূত- মারুত ফেরেস্তা) কাউকে যাদু শিক্ষা দিতেন না যতক্ষণ পর্যন্ত এই ক্থা না বলতেন-নিশ্চয় আমরা (তোমাদের জন্য) পরীক্ষা স্বরূপ। সুতরাং (আমাদের নিকট যাদু শিখে) কাফের হয়ো না”। [সূরা বাকারা : ১০২]
অষ্টমঃ
মুশরিকদেরকে মুসলমানদের বিরূদ্ধে সাহায্য সহযোগিতা করা। আল্লাহ তাআলার বাণী:

وَمَنْ يَتَوَلَّهُمْ مِنْكُمْ فَإنَّهُ مِنْهُمْ ، إنَّ اللهَ لاَ يَهْدِيْ الْقَوْمَ الظاَّلِمِيْنَ

“তোমাদের মধ্য হতে যে ওদের (অর্থাৎ বিধর্মীদের) সাথে বন্ধুত্ব করবে সে তাদেরই দলভূক্ত বলে গণ্য হবে। নিশ্চয় আল্লাহ যালেমদেরকে হেদায়াত দান করেন না”। [সূরা মায়েদা : ৫১]
নবমঃ
  এ বিশ্বাস করা যে, কারও জন্য মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর শরীয়তের বাইরে থাকার অবকাশ রয়েছে। যেমন (এক শ্রেণীর ভণ্ড সূফীর ধারণা অনুপাতে) অবকাশ ছিল খিযির (আ:)এর জন্য মূসার (আ:) শরীয়ত হতে বাইরে থাকার। এ বিশ্বাসেও সে কাফের হয়ে যাবে। আল্লাহ তাআলা বলেন:

وَمَنْ يَبْتَغِ غَيْرَ الإسْلاَمِ دِيْناً فَلَنْ يُقْبَلَ مِنْهُ وَهُوِ فِيْ الآخِرَةِ مِنَ الْخاَسِرِيْنَ

“যে ব্যক্তি ইসলাম ব্যতীত অন্য ধর্ম অন্বেষণ করবে তার থেকে তা গ্রহন করা হবে না। এবং সে পরকালে ক্ষতি গ্রস্থদের দলভূক্ত হবে”। 
[সূরা আলে ইমরান: ৮৫]
দশমঃ
সম্পূর্ণ রূপে আল্লাহর দ্বীন হতে বিমুখ থাকা। সে ব্যাপারে জ্ঞানার্জন না করা, তদানুযায়ী আমল না করা, এই ধরণের মন-মানষিকতার ব্যক্তিও কাফের বলে পরিগণিত হবে। আল্লাহ তাআলা বলেনঃ

وَمَنْ أظْلَمُ مِمَّنْ ذُكِّرَ بِآياَتِ رَبِّهِ ثُمَّ أعْرَضَ عَنْهاَ ، إناَّ مِنَ الْمُجْرِمِيْنَ مُنْتَقِمُوْنَ

“ঐ ব্যক্তি অপেক্ষা কে বেশী যালিম (অত্যাচারী) হতে পারে, যাকে উপদেশ দেওযা হয়েছে স্বীয় প্রতিপালকের আয়াত সমূহ দ্বারা অত:পর সে উহা হতে বিমুখ হয়েছে? নিশ্চয় আমি অপরাধীদের থেকে প্রতিশোধ গ্রহণ কারী”। [সূরা সাজদাহ্‌ : ২২]
কোন লোক এ সকল বিষয়ে লিপ্ত হলে সে কাফের বলে বিবেচিত হবে চাই সে মজা করার জন্য এ সকল কাজ করুক বা গুরুত্ব সহকারে করুক, সেচ্ছায় করুক বা ভয়ে করুক। অবশ্য কাউকে যদি  বাধ্য করা হয় তবে তার ব্যাপার আলাদ।  এ সমস্ত ইসলাম বিধ্বংশ বিষয় অত্যন্ত মারাত্মক। তার পরও তা ব্যাপকভাবে এসব সংগঠিত হয়ে থাকে। সুতরাং মুসলিম ব্যক্তির উপর অপরিহার্য কর্তব্য হল এ সকল বিষয় থেকে সতর্ক থাকা। আমরা আল্লাহর নিকট তার ক্রোধ অবধারিত কারী বিষয় হতে এবং তাঁর যন্ত্রনা দায়ক শাস্তি হতে আশ্রয় প্রার্থনা করছি। সৃষ্টির সেরা মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের উপর, তাঁর পরিবারের উপর, সাহাবীগণের উপর আল্লাহ রহমত ও শান্তির ধারা অবতীর্ণ হোক।
[এখান থেকেই শাইখুল ইসলাম মুহাম্মাদ বিন সুলায়মান আত তামীমী (রহ:) এর বক্তব্য শেষ]।
উল্লেখিত চতুর্থ প্রকার ইসলাম বিধ্বংশী বিষয়ের অন্তর্ভূক্ত হবে ঐ ব্যক্তি যে বিশ্বাস করে যে, মানুষ যে সমস্ত সংবিধান রচনা করেছে উহা ইসলামী সংবিধানের চেয়েও উত্তম, অথবা উহার সম পর্যায়ের অথবা এই বিশ্বাস করে যে, ঐ সমস্ত মানব রচিত বিধানের নিকট ফায়সালা তলব করা জায়েয, যদিও শরীয়তের বিধানকেই সে উত্তম মনে করে- এধরণের সকল বিশ্বাসই চতুর্থ প্রকার ইসলাম বিধ্বংশী বিষয়ের অন্তর্ভূক্ত।
অনুরূপভাবে যদি কেউ বিশ্বাস করে যে ইসলামের বিধি-বিধান এই বিংশ শতাব্দীতে বাস্তবায়ন যোগ্য নয়। অথবা এই বিশ্বাস করে যে, ইহাই মূলত: মুসলিমদের পশ্চাদ মুখী হওয়ার কারণ। অথবা উহাকে সে স্বীয় প্রতি পালকের সাথে সর্ম্পর্কত করার মধ্যেই সীমিত রাখে, জীবনের অন্যান্য বিষয়ের কোন কর্তৃত্ব নেই বলে ধারণা করে।অর্থাৎ বলে যে শরীয়ত ব্যক্তিগত জিনিস, সমাজ, রাষ্ট বা জীবনের অন্য ক্ষেত্রে শরীয়তের প্রয়োজন নাই তাহলে সেও চতুর্থ প্রকার ইসলাম বিধ্বংশকারী আমল সম্দপনকারী কাফেরদের দলভূক্ত হবে।
অনুরূপ ভাবে চতুর্থ প্রকারে শামিল হবে ঐ ব্যক্তির কথা যে এমনটি ধারণা করে যে, চোরের হাত কাটা, বিবাহিত ব্যাভিচারীকে পাথর মেরে হত্যা করা ইত্যাদী আল্লাহর বিধান বাস্তবায়ন করা আধুনিক যুগের জন্য উপযোগী নয়।
অনুরূপ ভাবে চতুর্থ প্রকারের অন্তর্ভূক্ত ঐ ব্যক্তির কথা, যে বিশ্বাস করে যে বৈষয়িক বিষয় সমূহ এবং দণ্ডবিধি ইত্যাদির ব্যাপারে শরিয়ত ব্যতীত অন্য বিধান দিয়ে ফায়সালা করা জায়েয। যদিও সে এই বিশ্বাস না রাখে যে উহা শরীয়তের বিধান অপেক্ষা উত্তম। (তবুও সে কাফের বলেই গণ্য হবে) কারণ সে এর মাধ্যমে এমন বিষয়কে হালাল করেছে যা আল্লাহ হারাম করেছেন। আর যে ব্যক্তি আল্লাহর হারাম কৃত বিধানকে হালাল করবে যার হারাম হওয়া দ্বীন ইসলামে সর্বজন বিদিত। যেমন: ব্যাভিচার করা, মদ্যপান করা, সূদী কারবার করা, আল্লাহর শরীয়ত ব্যতীত অন্য বিধান দ্বারা ফায়সালা করা ইত্যাদী বিষয়কে যে হালাল মনে করবে সে মুসলমানদের সর্ব সম্মতিক্রমে কাফের বলে গণ্য হবে।
আমরা আল্লাহর সমীপে এই কামনা করি, তিনি যেন সকলকে তাঁর সন্তুষ্টি মূলক কাজের তাওফীক দেন এবং আমাদেরকে এবং সমস্ত মুসলিমদেরকে সঠিক পথের হেদায়াত দান করেন। নিশ্চয় তিনি সর্ব শ্রোতা ও নিকটবর্তী। আল্লাহ্‌ তাআলা নবী মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম, তাঁর পরিবার বর্গ ও সাহাবীদের উপর রহমত ও শান্তির ধারা অবতীর্ণ করূন।
আমীন॥



Peace Be Upon You

Peace Be Upon You