Tuesday, March 31, 2015

অন্ততপক্ষে তুমি আমার মাথায় একটা চুম্বন করো, তাহলেও আমি তোমাকে ছেড়ে দেবো










রোমান সম্রাট হিরাক্লিয়াসঃ “অন্ততপক্ষে তুমি আমার মাথায় একটা চুম্বন করো, তাহলেও আমি তোমাকে ছেড়ে দেবো”।
উমার ইবন খাত্তাব রাঃএর শাসনকাল চলছে। এক সময়কার অজেয় দুই সাম্রাজ্য যুগপতভাবে মুসলিমদের দখলে চলে আসছে। রোমান সম্রাট হিরাক্লিয়াস সিরিয়ার বিশাল এলাকা ছেড়ে ক্রমাগত দূরে সরে যাচ্ছেন। কয়েকটি যুদ্ধক্ষেত্রে যুদ্ধ হচ্ছে মুসলিম ও রোমানদের মধ্যে। হিজরী ১৯ সালে খলিফা উমার রাঃ এমনই এক বাহিনী পাঠালেন রোমানদের বিরুদ্ধে, যে বাহিনীতে আব্দুল্লাহ বিন হুজাফাহ আস সাহমী(রাঃ)ও ছিলেন। হিরাক্লিয়াস মুসলিমদের দৃঢ় ঈমান, বীরত্ব আর আল্লহর জন্য অকাতরে প্রাণ বিলিয়ে দেয়ার অনেক ঘটনা শুনতেন। তাই তিনি তাঁর সেনাদের নির্দেশ দিয়েছিলেন কোন মুসলিম সেনা বন্দী করা হলে তাকে যেন জীবন্ত অবস্থায় তাঁর কাছে আনা হয়। ঘটনাক্রমে রোমানদের হাতে আব্দুল্লাহ বিন হুজাফাহ আর আরো ক’জন মুসলিম সেনা বন্দী হলেন। এঁদের সবাইকে শক্ত করে বেঁধে নিয়ে আসা হলো সম্রাট হিরাক্লিয়াসের কাছে। উল্লসিত রোমান সেনারা সম্রাটকে বললো,
“এই লোক মুহাম্মাদের একজন সহচর আর প্রথমভাগেই সে এ দীন গ্রহন করেছে। আমরা তাকে জীবন্ত আপনার কাছে হাজির করেছি”।
রোমান সম্রাট দীর্ঘক্ষণ আব্দুল্লাহর দিকে তাকিয়ে রইলেন, এরপর বন্দী আবদুল্লাহর দিকে তাকিয়ে কথা বললেন তিনি,
হিরাক্লিয়াসঃ আমি তোমার কাছে একটি বিষয় উপস্থাপন করতে চাই।
আবদুল্লাহঃ বিষয়টি কি?
হিরাক্লিয়াসঃ তুমি খৃষ্টধর্ম গ্রহণ করো। যদি তা করো তাহলে তোমাকে মুক্তি দেব আর সম্মানিতও করবো
আবদুল্লাহঃ আফসোস, যেদিকে আপনি আমাকে ডাকছেন, তার চেয়ে হাজারবার মৃত্যুও আমার কাছে বেশী প্রিয়।
হিরাক্লিয়াসঃ আমি মনে করি তুমি একজন বুদ্ধিমান লোক। আমার প্রস্তাব মেনে নিলে আমি তোমাকে ক্ষমতার অংশীদার বানাবো, তোমার কাছে আমার মেয়েকেও বিয়ে দেবো।
আবদুল্লাহ মৃদু হাসলেনঃ আল্লাহর শপথ, আপনার গোটা সাম্রাজ্য আর সাথে আরবদের অধিকারে যা কিছু আছে তার সবই যদি আমাকে দেয়া হয় আর বিনিময়ে বলা হয় রাসুল্লাল্লাহ সাঃ আনীত দীনকে এক মুহূর্তের জন্যও ত্যাগ করতে, আমি তা করবোনা।
হিরাক্লিয়াসঃ তাহলে আমি তোমাকে হত্যা করবো এখনই।
আবদুল্লাহঃ আপনার যা খুশী আপনি করতে পারেন।
সম্রাটের নির্দেশে শুলিকাষ্ঠ প্রস্তুত করা হলো। ফাঁসিতে না ঝুলিয়ে বন্দীকে দুহাত বেঁধে শূন্যে দেহে ঝুলিয়ে দেয়া হলো। এবার তার কাছে খৃষ্টধর্ম পেশ করা হলো। তিনি অস্বীকার করলেন। এরপর নামিয়ে এনে দুপায়ে ঝুলানো হলো এবং এবার শুধু ইসলাম ত্যাগের ঘোষণা দেয়ার আহবান জানানো হলো। এবারও বন্দী দৃঢ়ভাবে অস্বীকার করলেন। সম্রাটের রাগ বেড়ে চলেছে। তিনি বন্দীকে নামিয়ে আনতে ইশারা করলেন। বন্দীকে নামিয়ে আনা হলো। এবার সম্রাট সেনাবাহিনীর বিশাল সেনাদলের রান্নার জন্য ব্যবহার করা বিশাল কড়াই আনতে বললেন। কড়াই এনে সম্রাটের নির্দেশে তাতে তেল ঢালা হলো আর বন্দীকে সামনে বেঁধে রেখে কড়াইয়ের তেল ফুটিয়ে উত্তপ্ত করা হলো। এবার বন্দীদের থেকে দুজনকে সামনে আনা হলো। এদের ভেতর একজনকে পাঁজাকোলা করে উত্তপ্ত তেলে ফেলে দেয়া হলো। কিছুক্ষণের ভেতর তার হাড় থেকে মাংস খসে পড়তে লাগলো আর মৃত্যু হতে সময় লাগলো খুবই কম।
সম্রাট এবার আবার আবদুল্লাহকে ডেকে খৃষ্টধর্ম গ্রহণ করার আহবান করলেন। আবদুল্লাহ এবার আগের চেয়েও কঠোরভাবে তা প্রত্যাখ্যান করলেন। সম্রাটের নির্দেশে তাঁকে সেই কড়াইয়ের সামনে আনা হলো। আবদুল্লাহর চোখে এবার অশ্রু দেখা গেলো। লোকেরা সম্রাটকে বললো, “বন্দী এবার কাঁদছে”। সম্রাট বন্দীকে নামিয়ে আনতে বললেন। আবদুল্লাহকে নামিয়ে আনা হলো এবং সম্রাট আবার তাঁকে ইসলাম ত্যাগ করার প্রস্তাব দিলেন। আবদুল্লাহ আবারো কঠোরভাবে তা প্রত্যাখ্যান করলেন। সম্রাট বললেন,
“ধ্বংস হও তুমি। তাহলে তুমি কাঁদছিলে কেন?”
“আমি এজন্য কাঁদছিলাম যে, আমাকে এখন কড়াইয়ে ফেলা হবে আর আমার প্রাণ যাবে আল্লাহর জন্য যা আমি চেয়েছি। অথচ এখন আমার মনে হচ্ছে আমার যদি দেহের পশমের মতো অসংখ্য জীবন থাকতো, তাহলে তার সবই যদি আমি আল্লাহর জন্য বিলিয়ে দিতে পারতাম”।
সম্রাট খুব অসহায় বোধ করলেন। এক বন্দীর হাতে রোমান সম্রাটের এমন নাস্তানাবুদ অবস্থা পারিষদরা আর মেনে নিতে চাইছিলেন না। একজন সমাটের কানে পরামর্শ দিলেন। সম্রাট এবার বললেন,
“অন্ততপক্ষে তুমি আমার মাথায় একটা চুম্বন করো, তাহলেও আমি তোমাকে ছেড়ে দেবো”।
প্রথমে অস্বীকার করলেও আবদুল্লাহ বিন হুজাফাহ আস সাহমী এবার এর বিনিময়ে সকল বন্দীর মুক্তির শর্তে তা করতে রাজী বলে জানালেন। তিনি বললেন,
“যদি আমার সাথে অন্য মুসলিম বন্দীদেরও মুক্তি দেয়া হয়, আমি রাজী আছি”।
সম্রাট বললেন, “হ্যাঁ, অন্যদেরও ছেড়ে দেয়া হবে”।
আবদুল্লাহর বাঁধন ও বেড়ি খুলে দেয়া হলো। তিনি ধীর পায়ে হেঁটে গিয়ে সম্রাট হিরাক্লিয়াসের মাথায় চুম্বন করলেন। সম্রাট সকল মুসলিম বন্দীদের আবদুল্লাহর হাতে তুলে দেয়ার নির্দেশ দিলেন। সর্বোমোট ৮০ জন বন্দী মুক্তি পেলো।
আবদুল্লাহ বিন হুজাফাহ (রাঃ) মদীনায় ফিরে পুরো ঘটনা সবিস্তারে খলিফা উমারের (রাঃ) কাছে বর্ণনা করলেন। আনন্দে উমারের চোখ উদ্ভাসিত হয়ে উঠলো। তিনি উপস্থিত বন্দীদের দিকে তাকিয়ে বললেন, “প্রতিটি মুসলিমের উচিৎ আবদুল্লাহর মাথায় চুম্বন করা। আমিই তার সূচনা করছি”। এই বলে তিনি উঠে গিয়ে আবদুল্লাহর মাথায় চুম্বন করলেন।

(আবদুল্লাহ ও হিরাক্লিয়াসের এ ঘটনার বর্ণনাটি এসেছে যথাক্রমে হায়াতুস সাহাবা ১/৩০২, আল ইসাবা ২/২৯৬-৯৭, আল ইসতিয়ার, সুয়ারু মিন হায়াতিস সাহাবা ১/৫১-৫৬, উসুদুল গাবাহ ৩/১৪৩ ইত্যাদি নির্ভরযোগ্য ইতিহাস গ্রন্থে)

Writer: Amin Beg.

No comments:

Post a Comment

Peace Be Upon You

Peace Be Upon You